বিপ্লব রহমান
বাঙালি মুসলিমদের দুটি বড় ধর্মীয় উৎসব -- রোজা ও কোরবানীর ঈদ। বাংলাদেশে আবার রোজার ঈদটিই প্রধান। এর আনুষ্ঠানিক নাম ঈদুল ফিতর।
একমাস রোজা রেখে সিয়াম (কৃচ্ছতা ও সংযম) সাধণার পর মুসলিম সম্প্রদায় পালন করেন এই মাহে রমজানের ঈদ। ধর্মীয় রীতি মেনে এই মাসে গরীব-দুস্থ ও এতিম (পিতৃমাতৃহীন) শিশুদের দান-খয়রাত (যাকাত ও ফিতরা) করা হয়। স্বচ্ছল উপর্জনকারীদের জন্য আয়ের অনুপাতে নির্দিষ্ট করা হয় ফিতরা (দানের অর্থ)। আর যাকাত হিসেবে দেওয়া হয় নতুন কাপড়।
রমজান মাসের অন্যতম আকর্ষণ সেহরী ও ইফতার। ভোররাতে অজু করার পর খাবার খেয়ে নামাজ পড়ে রোজা রাখার শুরুই সেহরী। পরিবারের ছোটবড় সকলে মিলে ভোররাতে একসাথে আহার বা সেহরী খাওয়া অন্যরকম ধর্মীয় পারিবারিক বন্ধন তৈরি করে।
মসজিদের শহর ঢাকায় কয়েক দশক আগে এতো মাইক ছিল না। ঘরে ঘরে ছিল না মোবাইল এলার্ম ক্লক, রেডিও-টিভি। সে সময় একদল যুবক সুরেলা গলায় গান গেয়ে ঘুম ভাঙাতেন রোজদারদের। পুরনো ঢাকার পেশাদার এই সাংস্কৃতিক গানের দলকে ‘কাসিদা‘ বলা হতো।
তাদের গানগুলো ছিল অনেকটা এরকম:
‘আবতো বো ভিদো ইয়া খাবো ঘিড়া, আব রাজগুজারনে ওয়ালি হে।‘...
‘পবিত্র রমজান মোমিনদের তরে এলোরে আবার দুনিয়ায়।‘...
অথবা,
‘এই রমজান এই সেহরি ভুলে যেওনা সকলে,
খাইতে হবে, খাইতে হবে, গরজ করো সকলে‘...
কাসিদার গানের দলে সাধারণত একজন লিড ভোকাল থাকেন। অন্যরা কোরাসে ধুয়ো ধরেন তার সাথে। তাদের গানে ঘুম ভেঙে সেহরী খান সকলে। আর ঈদের সময় পাড়ার সকলে মিলে কাসিদা দলকে দেন মোটা অংকের বকশিশ।
তবে ডিজিটাল এই যুগে কাসিদার আর দেখা মেলে না। মসজিদের মাইকে আহবান ও দমকল বাহিনীর সাইরেনে ভোর রাতে জেগে উঠে ঢাকা। ঘরে ঘরে চলে সেহরীর আয়োজন। আর এখন উচ্চবিত্তের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে নামিদামী রেস্তোরাঁয় ‘সেহরী পার্টি‘। স্যোশাল মিডিয়ায় এসব পার্টির সেলফি দেওয়াই এখন যেন রীতি।
রোজার আরেক আকর্ষণ ইফতার। সারাদিন উপবাসের পর ইফতার খেয়ে রোজা ভাঙা হয় বলে একে মুখরোচক করতে থাকে নানা আয়োজন।
আবার পুরনো ঢাকার চকবাজারের ইফতারের রয়েছে ঐতিহ্য। সেখানের ইফতারে বেগুনি, পেয়াজু, আলু চপ, পাতা বড়া, ছোলা ভাজা, শাহী জিলাপি, হালিম (কয়েক ধরনের ডাল ও মাংস দিয়ে বানানো), বটি কাবাব, সুতি কাবাব, হাঁড়ি কাবাব, শিক কাবাব, কাচ্চি (মাটন) বিরিয়ানি, তেহরী (বিফ পোলাও), মোরগ পোলাও ইত্যাদি অন্যতম। ইফতারে নানা রকম ফলের রস ও সরবত রোজদারের দেহমনকে চাঙ্গা রাখে। ইফতারের অন্যতম অনুসঙ্গ মুড়ি ও খেজুর। অনেক মুসলিম বিশ্বাস করেন, খেজুরই একমাত্র বেহেশতি মেওয়া।
রাজনৈতিক দলগুলো ‘ইফতার পার্টি‘তে ঘরোয়া মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ইফতার অভিনব। মুসিল্লিরা চাঁদা তুলে শত শত দুস্থ রোজদারকে বিনামূল্যে ইফতার খাওয়ান। থানা পুলিশ ও হাজতির একত্রে ইফতার এখন আর নতুন খবর নয়। বে-রোজদার ও অন্য ধর্মের মানুষজনও সানন্দে অংশ নেন ইফতারে।
আর এক মাস রোজার পর ঈদ ছড়ায় ব্যপক খুশী। নতুন কাপড়, সেমাই, পায়েশ, পোলাও-কোর্মা-জর্দার আয়োজন চলে ঘরে ঘরে। বড়দের কাছ থেকে সালামী আদায় ছোটদের কাছে ঈদের আরেক বড় আকর্ষণ। রেডিও-টিভি-সংবাদপত্রে বিশেষ আয়োজন থাকে ঈদকে ঘিরে। টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ ঈদ নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, লাইভ কনসার্টে দর্শক-শ্রোত টানে। সংবাদপত্রগুলো বর্ধিত কলেবরে বের করে সাহিত্যপাতা – ঈদ সংখ্যা।
ঈদের আগের দিন চাঁদ রাতে ঘরে ঘরে রেডিও-টিভিতে সমস্বরে বাজে আবশ্যকীয় নজরুলগীত:
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ।।
তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙ্গাইতে নিঁদ।।
তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।।
আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত দুশমন হাত মিলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা নিত- উপবাসী
সেই গরীব মিস্কিন দে যা কিছু মফিদ।।
ঢাল হৃদয়ের তোর তশতরীতে শিরনী তৌহিদের,
তোর দওত করবুল করবেন হযরত, হয় মনে উমিদ।।
তোরে মারল ছুঁড়ে জুড়ে ইঁট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গ’ড়ে প্রেমেরি মসজিদ।।‘
--