দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে, নরেন্দ্র মোদীর সাধের সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলির মধ্যে একটিকে জীবন্ত করার দিনরাত এক করে লড়াই চালিয়ে গেছেন কয়েক হাজার শ্রমিক। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফল আজকের এই নয়া সংসদ ভবন। তাদের ছাড়া এই স্বপ্নের প্রকল্প বাস্তবায়ন একেবারেই সম্ভব ছিল না। কাজ শেষে আজ উদ্বোধনের দিন নয়া সংসদ ভবনকে বিরাট সার্টিফিকেট দিলে পর্দার পিছনে হাজার হাজার শ্রমিক। তাঁদের কথায়, 'নতুন সংসদ ভবন একেবারে যেন স্বর্গ'।
রবিবার অর্থাৎ ২৮ মে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সকাল ৭.১৫ মিনিটে এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে। বৈদিক আচার অনুষ্ঠানে মাধ্যমে শুরু হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলবে ৭ ঘণ্টা ধরে। দুই ধাপে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রথম পর্বে সকাল সোয়া ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বিশেষ পুজো ও আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টায় সংসদ ভবনের লবিতে এক প্রার্থনা অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী মোদী সংসদ ভবন প্রাগন থেকে বের হবে। এরপরের পর্বের অনুষ্ঠান শুরু হবে বেলা সাড়ে ১১টায়। বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, ধর্মীয় নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এদিকে সংসদ ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আজ রবিবার দুপুর ১টায় ৭৫ টাকার কয়েন ও একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হবে। সেই সঙ্গে দুপুর ১টা বেজে ১০ মিনিটে মোদীর ভাষণ পর্ব শেষে দুপুর ২টোয় আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি।
নতুন সংসদ ভবনে থাকছে অত্যাধুনিক হাই-টেক সুযোগ-সুবিধা। সংসদের প্রতিটি আসনে ডিজিটাল অডিও-ভিডিও সিস্টেম, টাচ স্ক্রিন বসানো হয়েছে। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য প্রদর্শন করা হয়েছে সংবিধান হলে। গ্রিন বিল্ডিং হওয়ায় বিল্ডিংটিতে বিদ্যুৎ খরচ ৩০% কম হবে। এছাড়াও অডিও ভিজ্যুয়াল সিস্টেমে সজ্জিত ৬টি বড় কনফারেন্স হল রয়েছে। পাশাপাশি মন্ত্রীদের ব্যবহারের জন্য ৯২টি কক্ষও করা হয়েছে নয়া সংসদ ভবনে। নতুন সংসদ ভবনেই লোকসভার স্পিকারের চেয়ারের পাশে স্থাপন করা হবে সেঙ্গোল। স্বাধীনতার সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতীক হিসাবে এই সেঙ্গোল ব্যবহার করা হয়েছিল।
দেশের অধিকাংশ রাজ্য থেকে আনা জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে নতুন সংসদ নির্মাণে। নয়া সংসদ ভবনে মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে আনা সেগুন কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। রাজস্থানের সরমথুরা থেকে আনা বেলেপাথর বসানো হয়েছে। এই পাথর লাল কেল্লা এবং হুমায়ুনের সমাধিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। মির্জাপুর থেকে আনা কার্পেট বিছানো হয়েছে নয়া সংসদ ভবনে। ত্রিপুরা থেকে আনা বাঁশের ব্যবহার করা হয়েছে সংসদ ভবন নির্মাণে। আহমেদাবাদের এইচসিপি ডিজাইন, প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে স্থপতি বিমল প্যাটেল নতুন সংসদ ভবনের নকশা তৈরি করেছেন। বর্তমান সংসদ ভবনের পাশেই তৈরি হয়েছে নতুন ভবনটি। বানিয়েছে টাটা প্রজেক্টস লিমিটেড।
বর্তমান সংসদ ভবনের পাশে তৈরি হয়েছে নতুন ভবনটি। বর্তমান সংসদ ভবনের লোকসভায় ৫৪৩ জন ও রাজ্যসভায় ২৫০ জন বসতে পারেন। নতুন সংসদ ভবনে লোকসভায় ৮৮৮ জন এবং রাজ্যসভায় ৩০০ জন সংসদ সদস্য বসতে সক্ষম। নতুন সংসদ ভবনটি প্রায় ৬৪,৫০০ বর্গমিটারজুড়ে রয়েছে। পুরনোটি একটি বৃত্তাকার ভবন। যার ব্যাস ৫৬০ ফুট (১৭০.৬৯ মিটার)। এর পরিধি এক মাইলের এক তৃতীয়াংশ বা ৫৩৬.৩৩ মিটার। আর, প্রায় ছয় একর (২৪,২৮১ বর্গমিটার) এলাকাজুড়ে পুরনো সংসদ ভবন চত্বর। নতুন ভবনে পুরনো সংসদ ভবনের মত কোনও কেন্দ্রীয় হল নেই। তার বদলে লোকসভা চেম্বারটিই যৌথ অধিবেশনের জন্য ব্যবহার করা হবে।
সেন্ট্রাল ভিস্তার ওয়েবসাইট অনুসারে, পুরনো বিল্ডিংয়ে অগ্নি নিরাপত্তা একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল। কারণ, এটি বর্তমান অগ্নি নিরাপত্তার নিয়ম অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়নি। তার ওপর বেশ কয়েকটি বিদ্যুতের তার জোড়া হয়েছে।, যাতে আগুনের ঝুঁকি বেড়েছে। পাশাপাশি, অন্যান্য নানা সংযোজনের ফলে বিল্ডিংয়ের সামগ্রিক নান্দনিকতাই নষ্ট হয়ে গেছে। সেই কথা মাথায় রেখে, নতুন পার্লামেন্ট ভবনে জল সরবরাহ লাইন, নর্দমা লাইন, এয়ার কন্ডিশনার, অগ্নিনির্বাপক, সিসিটিভি, অডিও-ভিডিও সিস্টেম পরিষেবাগুলো সময় উপযোগী করা হয়েছে। নতুন ভবনে ইতিমধ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ভোটদান সহজ করার বায়োমেট্রিক্স। ডিজিটাল ভাষা ব্যাখ্যা বা অনুবাদের ব্যবস্থা এবং প্রোগ্রামেবল মাইক্রোফোন। হলগুলোয় আছে অভ্যন্তরীণ ভার্চুয়াল সাউন্ড সিস্টেম। যাতে প্রতিধ্বনির সঠিক মাত্রা সেট করা যায়।
বর্তমান বা পুরনো সংসদ ভবন ঔপনিবেশিক যুগের ভবন। ব্রিটিশ স্থপতি স্যার এডউইন লুটিয়েন্স এবং হার্বার্ট বেকার তার ডিজাইন করেছিল। আর, নতুন ভবনটি আহমেদাবাদ-ভিত্তিক এইচসিপি ডিজাইন, প্ল্যানিং এবং ম্যানেজমেন্ট দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছে। সেন্ট্রাল ভিস্তার ওয়েবসাইট অনুসারে, নতুন সংসদ ভবন এবং পুরনো সংসদ ভবনে যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, তা যৌথভাবে ব্যবহার করা হবে। সনাতন পরম্পরা এবং বাস্তুশাস্ত্র মেনে প্রায় ৫,০০০ শিল্পকর্ম (পেইন্টিং, আলংকারিক শিল্প, প্রাচীর প্যানেল, পাথরের ভাস্কর্য এবং ধাতব বস্তু) নতুন সংসদ ভবনজুড়ে রয়েছে। আনুমানিক ১,২০০ কোটি টাকায় তৈরি নতুন ভবনটি সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের অংশ। যার মধ্যে একটি যৌথ কেন্দ্রীয় সচিবালয়, রাজপথের ব্যবস্থা, প্রধানমন্ত্রীর নতুন বাসভবন, প্রধানমন্ত্রীর নতুন কার্যালয়ও আছে। ভাইস প্রেসিডেন্টের ভবনও আছে। পুরানো সংসদ ভবনটি নির্মাণে ছয় বছর সময় লেগেছিল (১৯২১-১৯২৭)। খরচ হয়েছিল ৮৩ লক্ষ টাকা।
সোহিত কুমার শর্মা, যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে নয়া এই সংসদ ভবন নির্মাণে তিনি বলেন, “ গতকাল রাত্রে মাত্র ২ ঘন্টা ঘুমিয়েছি। দেশের জন্য আমরা অন্তত এইটুকু করতে পেরে গর্বিত। আজকের উদ্বোধনে আমরা ভবনের ভিতর থাকতে পারছি না ঠিকই তবে দারুণ লাগছে”।
বিহারের আকাশ কুমার, তিনিও এই সাফল্যের সাক্ষী। দিন রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন। আকাশ বলেন, “ আমরা গত এক সপ্তাহ ধরে দিনে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ ঘন্টা ধরে কাজ করেছি। সঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে পেরে আমরা খুশি। সংসদ ভবনের ভিতরটা দেখলে চোখ ধাধিঁয়ে যাবে”।
বিহারের অপর এক শ্রমিক ইমরান, বলেছেন যে ভবনের কিছু অংশ তৈরির কাজ এখনও চলছে এবং এটি সম্পূর্ণ হতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে। মধ্য প্রদেশের আরেক শ্রমিক রামদীন ডাগর বলেন, কয়েকটি চেম্বারে প্রয়োজনীয় কিছু আসবাবপত্র ছাড়া ভবনের বেশিরভাগ কাজই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। ‘একদম জান্নাত’ । তিনি বলেন, “মহামারীর সময়েও আমাদের কাজ চলেছে। প্রতিমাসে উপর্জন বলতে ১৭-১৮ হাজার টাকা, তবে এমন ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে পেরে আমরা খুশি”।