গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পুনেতে আয়োজিত এলগার পরিষদের অনুষ্ঠানের পরদিন বিভিন্ন জায়গায় যে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, তাতে যোগাযোগ ছিল মাওবাদীদের, এমনটাই অভিযোগ পুলিশের। সেই ঘটনার জেরে পুলিশ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ৭ জন অ্যাক্টিভিস্ট ও আইনজীবীদের বাড়িতে হানা দেয়। বিখ্যাত তেলুগু কবি ভারভারা রাও, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী সুধা ভরদ্বাজ, নাগরিক অধিকার কর্মী গৌতম নওলাখা, লেখক ও নাগরিক অধিকার কর্মী ভার্নন গনজালভেজ এবং অরুণ ফেরেইরারার বাড়িতে পৌঁছয় পুলিশ বাহিনী। ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, অরুণ ফেরেইরা, ভার্নন গনজালভেজ এবং গৌতম নওলাখাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
স্টান স্বামী (রাঁচি), বাড়িতে হানা দিয়েছে পুলিশ
রাঁচিতে জেসুইট পাদ্রি স্টান স্বামীর বাড়িতে তল্লাশি চালায় পুলিশ। গত জুলাই মাসে ঝাড়খণ্ড পুলিশ তাঁর সম্পর্কে ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র অভিযোগ এনেছিল। পাটঠালগাড়ি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়। পাটঠালগাড়ি আন্দোলন রাষ্ট্রের সঙ্গে আদিবাসীদের একপ্রকার যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে। এই আন্দোলনে তফশিলি উপজাতি এলাকায় ‘গ্রাম সভা’কেই সর্বোচ্চ বলে গণ্য করা হয়, রাষ্ট্রের কোনও আধিকারিক গ্রামসভার অনুমতি ব্যাতীত গ্রামে প্রবেশ করতে পারেন না।
এফ আই আরে স্টান স্বামী ছাড়া নাম ছিল আরও ১৯ জনের। অভিযোগ ছিল, বোকাসোকা ও নিরীহ আদিবাসীদের ফেসবুকের মত মাধ্যম ব্যবহার করে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে। এ কাজে লাগানো হয়েছে আদিবাসী মহাসভা, ‘অ্যান্টি ক্রাইস্ট ভারত পরিবার’-এর মত সংগঠনকেও। এই এফআইআর-এর প্রেক্ষিতে ৮১ বছর বয়সী স্টান স্বামী একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটির শিরোনাম ছিল, ‘আমি কি একজন দেশদ্রোহী?’ স্টান স্বামী লিখেছিলেন, আদিবাসীদের নিজস্ব ভূমি থেকে উৎখাত করার সরকারি নীতির তিনি একজন তীব্র সমালোচক, এবং সেই আইন এবং নীতিগুলিকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আসছেন। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘এরজন্য যদি আমাকে দেশদ্রোহী বলা হয়, তবে তাই সই।’’ স্টান স্বামীর লিঙ্কডইন প্রোফাইলে লেখা রয়েছে, তিনি স্বাধীন উচ্চশিক্ষাবিদ, গবেষক এবং লেখক। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে গ্রিনহান্ট অপারেশনের তিনি তীব্র বিরোধী ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি একটি গবেষণার জন্য অর্থ জুগিয়েছিলেন। ওই গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল, ‘ঝাড়খন্ডের বিচারাধীন’। গবেষণার মূল ল্ক্ষ্য ছিল রাজ্যের আদিবাসী ও মূলবাসীদের মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং ধনী ব্যক্তিরা রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করছে।
সুধা ভরদ্বাজ (ফরিদাবাদ), গ্রেফতার
৫৭ বছরের সুধা ভরদ্বাজ মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী। সুধা জন্মেছিলেন আমেরিকায়, ১১ বছর বয়সে ভারতে চলে আসেন তিনি। ১৮ বছর বয়সে মার্কিন নাগরিকত্ব ছেড়ে দেন। সুধাবিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত রঙ্গনাথ ভরদ্বাজ এবং কৃষ্ণা ভরদ্বাজের কন্যা। কৃষ্ণা ভরদ্বাজ এমআইটি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে তাঁর নামাঙ্কিত একটি ভাষণ রয়েছে। গত ৩০ বছর ধরে সুধা ছত্তিশগড়ে ছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি দিল্লি চলে আসেন এবং ন্যাশনাল ল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। সুধা ভরদ্বাজ পিইউসিএল-এর সাধারণ সম্পাদক।
আইআইটি কানপুর থেকে গণিত নিয়ে পড়াশুনো করে ১৯৮৪ সালে স্নাতক হন তিনি। শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে যোগ দেন তৎকালীন অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশের শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠন ছত্তিসগড় মুক্তি মোর্চায়। সুধা ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং নিরাপদ কর্মস্থলের দাবিতে লড়াই চালিয়ে গেছেন। ২০০০ সালে তিনি আইনের ডিগ্রি পাশ করেন এবং তার পর থেকে মানবাধিকার খর্ব করার বেশ কিছু মামলা হাতে তুলে নেন। একই সঙ্গে লড়তে শুরু করেন বেশ কিছু শ্রমিক আইন সম্পর্কিত মামলাও।
বিলাসপুরের বাসিন্দা সুধা ভরদ্বাজ বস্তার সলিডারিটি নেটওয়ার্ক এবং জগদলপুর লিগ্যাল এইড গ্রুপের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ২০১৩ সালে বিলাসপুরে নির্বীজকরণজনিত মৃত্যুর ঘটনায় সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে সুধা ভরদ্বাজের করা অভিযোগের ভিত্তিতে ছত্তিশগড় পুলিশ ও সুকমা জেলা আধিকারিকদের তীব্র তিরস্কার করেছিল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। অভিযোগ ছিল, ২০০৭ সালে সালওয়া জুড়ুমের স্পেশাল পুলিশ অফিসাররা সাতজনকে খুন করে বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনায় চোখ বন্ধ করেছিল পুলিশ প্রশাসন।
ভারভারা রাও (হায়দরাবাদ), গ্রেফতার
৭৮ বছরের ভারভারা রাওয়ের আদি নিবাস তেলেঙ্গানার ওয়ারঙ্গলে। তিনি বিপ্লবী কবি, সাহিত্য সমালোচক, নাগরিক অধিকার কর্মী এবং মাওবাদী সমর্থক হিসেবে খ্যাত। ভারভারা রাও অবিভক্ত অন্ধপ্রদেশে অভ্যুত্থানের চরম সময়ে শান্তি আলোচনা এবং সিজফায়ারের জন্য দৌত্য করেছেন অনেকবার। ভিরাসম (বিপ্লবী লেখক সংঘ)-এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা। ভিরাসম নকশালপন্থী আদর্শের পক্ষে কবিতা ও সাহিত্য প্রকাশ করে থাকে। ভারভারা রাওয়ের ১৫টি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে, যা দেশের ২০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৬৫ সালে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তেলুগু সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি পাওয়ার পর তিনি দিল্লিতে ডিএভিপি (ডিরেক্টরেট অফ অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড ভিজুয়াল পাবলিসিটি)-তে প্রকাশনা সহযোগীর চাকরিতে যোগ দেন, কিন্তু হঠাৎই চাকরি ছেড়ে হায়দরাবাদে ফিরে আসেন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য।
১০৭৫ সালে সেকন্দ্রাবাদ ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর ও আরও ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার। অভিযোগ ছিল তাঁরা বিপ্লবে মদত দিচ্ছেন। ১৯৮৯ সালে নিম্ন আদালতের রায়ে তাঁরা মুক্তি পান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্রের যে চিঠির কথা সামনে আসছে, অভিযোগ, সেই চিঠিতে ভারভারা রাওকে অর্থ জোগানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে গত ৮ জুন ভারভারা রাও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘‘আমাকে ফাঁসানোর জন্য চিঠিতে জাল করা হয়েছে। আমি সুরেন্দ্র গ্যাডলিং এবং রোনাল্ড উইসলনকে চিনি। ওঁরাও প্রফেসর জি এন সাইবাবার মুক্তির জন্য চেষ্টা করছেন। তার মানে এই নয় যে আমরা হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছি।’’
গৌতম নওলাখা (দিল্লি), গ্রেফতার
গোয়ালিয়রে জন্ম হয়েছিল গৌতম নওলাখার। তিনি পিইউডিআর-এর সক্রিয় কর্মী। মুম্বইয়ে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করেছেন গৌতম। ৬৫ বছরের গৌতম নওলাখা ডিজিটাল সংবাদপত্র নিউজক্লিকের সঙ্গে গত বছরখানেক ধরে যুক্ত রয়েছেন। ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি জার্নালে লেখালিখি করছেন গত ৩০ বছর ধরে। তাঁর সহযোগীরা জানিয়েছেন, এই প্রথম গৌতম নওলাখার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হল।
কাশ্মীর নিয়ে গৌতম নওলাখার বিস্তারিত কাজকর্ম সরকারকে প্রায়ই বিড়ম্বিত করেছে। তাঁর সাম্প্রতিক কাজকর্মের ফোকাস ছিল ছত্তিশগড়। ইপিডবলিউ পত্রিকার সাম্প্রতিক জুন সংখ্যায় তাঁর কাশ্মীর সংক্রান্ত লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
আনন্দ টেলটুম্বডে (গোয়া) সার্চ লিস্টে নাম
লেখক, রাজনৈতিক কর্মী, নাগরিক অধিকার রক্ষা কর্মী। মুম্বাইয়ে সিপিডিআর (কমিটি ফর প্রোটেকশন অফ ডেমোক্রেটিক রাইটস)-এর সঙ্গে যুক্ত। ইঞ্জিনায়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনো করেছেন, তবে তিনি বেশি পরিচিত দলিত ও প্রান্তিক সাহিত্যে অবদানের জন্য। এ বছরই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই রিপাবলিক অফ কাস্ট। যে বইয়ে তিনি সংবিধান, হিন্দুত্বের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা, এবং দলিতজীবনে তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। সে বইয়ে তিনি অভিযোগ করেছেন, নকশালদমনের নাম করে আদিবাসী জনজাতির উপর যুদ্ধ ঘোষণা করছে রাষ্ট্র।
আনন্দ বাম ও দলিত বিষয়ে বিভিন্ন জাতীয় পর্যায়ের দৈনিকে কলাম লিখেছেন। লিখেছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসেও। গোয়ায় তিনি গোয়া ইনস্টিট্যুট অফ ম্যানেজমেন্টের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
ভার্নন গনজালভেজ ( মহারাষ্ট্র) গ্রেফতার
বয়স ৬০। ২০০৭ সালে মুম্বই থেকে তাঁকে প্রথমবার গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি নিষিদ্ধ সিপিআই (মাওবাদী) গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। এটিএস একই সঙ্গে গ্রেফতার করে নকশালপন্থী বলে অভিযুক্ত শ্রীধর শ্রীনিবাসনকেও। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, নাশকতার ষড়যন্ত্র করা এবং কর্মী ইউনিয়নে প্রবেশ করে শিল্প ও শহুরে এলাকায় মাওবাদী ক্যাডার তৈরির ছক কষা। মুম্বইয়ের গোভান্দির একটি চাল থেকে নটি ডিটোনেটর, ২০টি জিলেটিন স্টিক, একটি ওয়াকি টকি, একটি কম্পিউটার ও নকশালপন্থী কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল এই বাডেয়াপ্ত জিনিসপত্রের উপর ভিত্তি করেই।
২০১৪ সালে নাগপুর সেশনস কোর্ট গনজালভেজকে অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক আইন এবং ইউএপিএ-তে দোষী সাব্যস্ত করে। তাঁকে ৩ বছরের তারাদণ্ড দেওয়া হয়। ইউএপিএ ধারায়, তাঁকে পাঁচ বছরের জেল দেওয়া হয়। মহারাষ্ট্রে কোনও নকশালপন্থীকে সেই প্রথমবার ইউএপিএ-তে শাস্তি দেওয়া হল। ম্যাঙ্গলোরের এক ক্যাথলিক দম্পতির পুত্র ভারনন গনজালভেজ দক্ষিণ মুম্বইয়ের বাইকুল্লায় একটি চালে বড় হয়েছেন। পরবর্তীকালে শহরের কলেজে অর্থনীতির শিক্ষককার কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি বিদর্ভের শ্রমিকদের অধিকারের দাবিতে লড়াই শুরু করেন।
অরুণ ফেরেইরা (মহারাষ্ট্র), গ্রেফতার
৪৮ বছর বয়সী মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এই প্রাক্তনী ২০০৭ সাল থেকে জেলে যাওয়া আসা করছেন। ২০০৭ সালের মে মাসে নিষিদ্ধ সংগঠন সিপিআই (মাওবাদীর সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে নাগপুর পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে ১০টি মামলা দায়ের করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।
৪ বছর ধরে নাগপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয় তাঁকে। ২০১১ সালে, জামিন পেয়ে তিনি যখন জেল থেকে বেরোচ্ছেন, তখন পুলিশ ফের তাঁকে গ্রেফতার করে, অভিযোগ, তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। যদিও, সে সময়ে নাগপুর জেলেই ছিলেন তিনি। ২০১২ সালে জামিন পান অরুণ, ২০১৪ সালে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত হন তিনি। জেলর মধ্যেকার পুলিশি অত্যাচার ও জেল জীবন নিয়ে কালার্স অফ কেজ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। ২০১৫ সালে বার কাউন্সিলের লাইসেন্স পেয়ে মুম্বইয়ে আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন অরুণ ফেরেইরা।
সম্প্রতি অরুণ ফেরেইরা এবং ভারনন গনজালভেজ একটি ওয়েব পোর্টালে তাঁদের জেলবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। জানিয়েছেন সূর্যালোক ও পরিষ্কার বাতাস না-থাকার কথা। বিজয় মালিয়া প্রত্য়র্পণের অনুমতির জন্য ব্রিটেনের আদালতকে আর্থার রোড জেলের যে ভিডিও সিবিআই পাঠিয়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে ওই লেখাটি লিখেছেন অরুণ ফেরেইরা-ভারনন গনজালভেজ।