গত ফেব্রুয়ারি মাসে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে প্রতিবেশী মায়ানমারের পরিস্থিতি। প্রায়ই বিক্ষোভে গর্জে উঠছেন সেদেশের গণতন্ত্রকামীরা। জুন্টা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছে মায়ারমারের চিন প্রদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ। ফলে এই রাজ্যের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেনা। প্রয়াই চলছে তল্লাশি। রাজ্যের গ্রামের পর গ্রামজুড়ে কেবলই হিংসার ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষকে জুন্টা সেনা নিপিড়ন করছে বলে অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে প্রাণের তাগিদে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মিজোরামে অনুপ্রবেশ ঘটছে হাজারে হাজারে মায়ানমারের চিন রাজ্যের নাগরিকের। উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির সরকারি সূত্র এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সহায়তা প্রদানকারী এনজিওগুলি-র দেওয়া তথ্য অনুসারে, ৫ জানুয়ারি থেকে মায়ানমারের চিন রাজ্য থেকে ২ হাজারের বেশি মানুষ মিজোরামের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে প্রবেশ করেছে৷
গত দুই সপ্তাহে মায়ানমারের যেসব নাগরিক এসেছেন তাদের মধ্যে চারজন ছুরির আঘাতে আহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। বাকিরা আইজলের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহত ব্যক্তির দেহ সীমান্ত পেরিয়ে মায়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়।
উল্লেখ্য, চিন ন্যাশনাল আর্মি দ্বারা সমর্থিত ও প্রশিক্ষিত চিন ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ) ও গণতন্ত্রপন্থী বেসামরিক প্রতিরোধ গোষ্ঠীর মধ্যে নাগাড়ে লড়াইয়ের সময় মায়ানমারের চিন রাজ্য থেকে প্রায় ১৫ হাজার নাগরিক গত জুলাই-আগস্টে মিজোরামে প্রবেশ করেছিলেন।
ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তের বেশিরভাগটাই মিজোরামের অন্তর্গত। এপারের মিজোরামের সঙ্গে মায়ানমারের চিন প্রদেশের সীমান্ত প্রায় ৫১০ কিলোমিটারের। বড় বিষয় হল যে, সীমান্তের উভয় পাশে একই জাতিসত্তার লোকেদের বসবাস।
সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই জুন্টা সরকারের মাথা ব্যথার কারণ চিন প্রদেশ। গণতন্ত্রের দাবিতে আগ্রাসী চিনপ্রদেশের মানুষের জোট ভাঙতে গতবছর শেষের দিকে ফালাম ও থান্টলাংয়ে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয় মায়ামমারের সেনা। কিন্তু হাল ছাড়েনি জুন্টা সরকার। ফলে প্রায়ই এই প্রদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে সরব অসামরিক প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে সেনা সরকারপন্থী ও সেনার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সেদেশের নিউজ পোর্টাল ফ্রন্টিয়ার মায়ানমারের তথ্য অনুসারে, চিন রাজ্যের পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং সেখানে ক্রমাগত সৈন্যরা আসছে। ফলে নতুন করে আক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এই মাসের শুরুতে, গণতন্ত্রকামী অসামরিক সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং জুন্টা সরকারের মধ্যে দক্ষিণে মাতুপি এবং উত্তরের তিদ্দিমে মারাত্মক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দিন কয়েক আগে ফালামেও সংঘর্ষের খবর মিলেছে।
সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, 'প্রাণের তাগিদে বর্তমানে প্রায়ই প্রতিদিনই নিয়ম করে সীমান্ত পেরিয়ে মায়ারমার থেকে এ দেশে নাগরিকরা চলে আসছেন।'
বেসরকারিভাবে অনুমান যে, চলতি বছর জানুয়ারির ৫-২০ তারিখের মধ্যে প্রায় ২ হাজার মায়ানমারের নাগরিক মিজোরামে প্রবেশ করেছেন। এর মধ্যে হানাথিয়ালে সবচেয়ে বেশি আগমন ঘটে, হিংসা থেকে থেকে বাঁচতে হাজারেরও বেশি মানুষ ভারতে এসেছেন। মিজোরামের হানথিয়ালের উল্টোদিকেই রয়েছে মায়ানমারের ফালাম। এ পারের লুংলেই ও লুয়াংটলাইলের বিপরীত প্রান্তে রয়েছে মায়ানমারের থান্টলাং, ফালাম এবং হাখহা। এই সময়ে সীমান্ত পেরিয়ে লুংলেই ও লুয়াংটলাইলে আসেন ১৩০০ মানুষ। সাইহা ও ত্রিপুরার সীমানার কাছে মিজোরামের মামিটে মায়ারমার থেকে এসেছে যথাক্রমে ১০০ ও ৮০০ মানুষ।
সরকারি সূত্র জানাচ্ছে যে, মায়ারমার থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারীদের দেখভালের জন্য মিজোরামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, চার্চগুলির তরফে 'রিফিউজি কেয়ারটেকার কমিটি' তৈরি হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এদের সহায়তা করছে। উদ্বাস্তুদের জন্য এই সংগঠন অর্থ, খাদ্য, ত্রাণ সংগ্রহ করেছে।
গত বছর, কেন্দ্র উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিকে এবং অসম রাইফেলসকে মায়ারমারের বাস্তুচ্যুত লোকদের কাউকে আশ্রয় না দেওয়ার ও নির্বাসিত করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা সেই আদেশ মানতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে শরণার্থীদের যত্ন নেওয়া মিজো জনগণের কর্তব্য। গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বৈঠক শেষে জানিয়েছিলেন যে, কেন্দ্র শরণার্থীদের সহায়তায় পরিকল্পনা তৈরি করতে চলেছে, এই মর্মেই তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। তাঁর কথায়, 'কেন্দ্র সাহায্য করতে ইচ্ছুক কিন্তু ভারত সরকার মায়ানমারের শরণার্থীদের সরাসরি সাহায্য করতে পারে না কারণ ভারত ১৯৫১ সালের ইউএন রিফিউজি কনভেনশন এবং ১৯৬৭-তে এর প্রোটোকলের স্বাক্ষরকারী নয়।'
Read in English