Advertisment

কোভিড-১৯ প্রশ্নের উত্তর দিতে ২৪ ঘণ্টা খোলা আসামের হেল্পলাইন

 আসামে ৩১ মার্চ প্রথম কোভিড সংক্রমণ দেখা দেয়। ২ এপ্রিল এ রাজ্যে সবচেয়ে বেশি কল আসে হেল্পলাইনে, যার পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Assam Covid Helpline

২০১০ সালে সারথি হেল্পলাইনের পথ চলা শুরু হয়েছিল

দিনের মধ্যে অসংখ্যবার তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?” তাঁর উদ্বেগ কখনও তাঁর কণ্ঠস্বরে ধরা পড়ে না। বাডিতে তাঁর দু বছরের সন্তান, প্রতিদিন বাড়ির বাইরে বের হওয়ার সময়ে মহিলা জানেন তাঁকে কী ঝুঁকি নিতে হবে। কিন্তু কাজে পৌঁছলে ২৭ বছরের ঋতুপর্ণা হাজারিকার মুখে উদ্বেগের লেশ থাকে না, একটা হেডসেট, একটা মাইক্রোফোন আর হাসি তাঁকে ঢেকে নেয়।

Advertisment

“শুরুর দিকে নার্ভাস লাগত, যখন জানতাম না কী উত্তর দিতে হবে”, এএনএম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঋতুপর্ণা বললেন। কয়েক সপ্তাহ আর কয়েকশ কল পেরিয়ে আসার পর সম্পূর্ণ আশ্চর্য কোনও প্রশ্নের মুখেও আর ঠোক্কর খান না তিনি। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “গত মাসে একজন আমাকে টিভি রিচার্জ করে দিতে বলেছিলেন।” অনেকবারই এমন হয়েছে, তিনি ফোন তুলেছেন, উল্টোদিকে কেউ একজন তারস্বরে গান জুড়েছে।

“আমি শান্তভাবে বুঝিয়ে বলি যে এটা একটা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত হেল্পলাইন, এবং আমি এখানে তাঁদের চিকিৎসা সম্পর্কিত সমস্যার উত্তর দিতে পারি।”

আসাম সরকার ও জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পিরামল স্বাস্থ্য গোষ্ঠী সারথি ১০৪ হেল্প সেন্টার চালাচ্ছে। এখানে ঋতুপর্ণার মত প্রায় ৯০ জন কাজ করেন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্যারামেডিক ও কাউন্সেলররা, যাঁরা আাসম জুড়ে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত মেডিক্যাল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য হাজির রয়েছেন সর্বক্ষণ।

এরকম একটা নয়, সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে হেল্পলাইনের সংখ্যা মহামারীর সময়ে বৃ্দ্ধি পেয়েছে। আসামে ৩১ মার্চ প্রথম কোভিড সংক্রমণ দেখা দেয়। ২ এপ্রিল এ রাজ্যে সবচেয়ে বেশি কল আসে হেল্পলাইনে, যার পরিমাণ প্রায় ৯০ হাজার।

২০১০ সালে সারথি হেল্পলাইনের পথ চলা শুরু হয়েছিল। তখন তারা কাজ করত সমস্ত রকম মেডিক্যাল তথ্য নিয়ে, কিন্তু মার্চে কোভিড অতিমারী শুরুর পর থেকে তারা কেবলমাত্র করোনাভাইরাসের জন্য তথ্যদায়ী হেল্পলাইনে পরিণত হয়।
পিরামল স্বাস্থ্য গোষ্ঠীর কথায় ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত তাদের সেন্টারে কল এসেছে ২,৬০,৫২৬। এর মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কল ৮০ শতাংশ।

এপ্রিলের শুরুতে কলের যে পরিমাণ বৃদ্ধি তার বেশিরভাগই আসাম সরকারের জনগণের কাছে আবেদনের সূত্রে। যাঁদের নিজেদের বা অন্য কারও সম্ভাব্য ভ্রমণের ইতিহাস রয়েছে তাঁদের সম্পর্কে জানাতে বলেছিল সরকার।

২৬ বছরের ফিজিওথেরাপির স্নাতক ভার্গবজ্যোতি কলিতা এই সংস্থায় কর্মরত। তিনি দিনে গড়ে ২৫০ কলের উত্তর দেন। ঋতুপর্ণা ও অন্য সহকর্মীদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অন্য একটা কম্পিউটারে বসে তিনি বললেন বেশিরভাগ কলই আসে গ্রামীণ অঞ্চল থেকে।

দুঘণ্টাও হয়নি তাঁর শিফট শুরু হয়েছে, বহু কল আসতে শুরু করেছে তাঁর কাছে। পাঁচ মিনিট কোনওরকমে বের করে কলিতা বললেন, “গ্রামের মানুষেরা অনেক সময়েই জানাতে চান যে তাঁদের এলাকায় কেউ বাইরে থেকে ফিরেছে। তাঁরা অনুরোধ করেন যাতে তাঁদের নাম না প্রকাশ করা হয়। না হলে অসুবিধেয় পড়বেন বলে জানান তাঁরা। একদিন একজন ফোন করে অভিযোগ করেছিলেন তাঁদের গ্রামে বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে।”

এরকম সব ক্ষেত্রেই কলিতা এই বার্তাগুলি পৌঁছে দেন ফ্লোর হেডের কাছে, তিনি সতর্ক করেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে, এর পর কার্যক্ষেত্রে অ্যাকশন নেওয়া শুরু হয়, কলিতা যেখানে অভিযোগ গ্রহণ করলেন, তার হয়ত কয়েকশ মাইল দূরের কোনও জায়গায়।

এর পর রয়েছেন বদমেজাজি কলাররাও। কলিতা বললেন, “ধরুন কেউ একজন কিছু একটা চাইলেন। কোনও কারণে তা পৌঁছনো গেল না। ওঁরা চিৎকার শুরু করেন, কীরকম হেল্পলাইন আপনারা! কেউ কেউ তো ননসেন্স বলে ফোন রেখে দেন।”

এরকম সময়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখাতে নেই সে কথা জানেন এই কর্মী সদস্যরা। কোভিড-১৯ কলের প্রশিক্ষণের অন্যতম শিক্ষা ছিল ঠান্ডা থাকা, যে পরিস্থিতিই হোক না কেন। কলিতা বললেন, “এটা টোল ফ্রি নাম্বার এবং যাঁরা ফোন করছেন, তাঁরা সকলে শিক্ষিত নন। আমরা বুঝি ওঁদের পক্ষেও কঠিন সময়, ওঁরা হতাশ, এবং কী ঘটে চলেছে তা সম্যক বুঝে উঠতে পারছেন না।”

গুয়াহাটির কেন্দ্রে তিনতলা এক বাড়িতে এঁদের অফিস। এঁদের শুধু কল ধরলেই চলে না, ফোন করতেও হয়। ১০৪ হেল্পলাইনের নোডাল অফিসার পমি বড়ুয়া বললেন, এ কলগুলো মূলত হোম কোয়ারান্টিন পরিস্থিতির খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। পমি দায়িত্বে এসেছেন মার্চের মাঝামাঝি। “সে সময়ে সকলেই ব্যস্ত। ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিই একটা নতুন দল তৈরি করার যাঁরা অফিস আসবেন না, বাড়িতে ল্যাপটপে কাজ করবেন। এঁরা সকলে স্বেচ্ছাসেবী, সচেতন নাগরিক, যাঁদের কাছে নাম ও ফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে, এঁরা কোয়ারান্টিনের খোঁজ খবর নেন, তাঁদের সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে খোঁজ খবর করেন।”

প্রয়োজন বুঝে নিজেদের সামর্থ্য বাড়াচ্ছে পিরামল স্বাস্থ্য। সংস্থার আসাম ও উত্তর পূর্ব প্রধান হরদীপ সিং বামবরা বললেন, “আমরা টিমের উপর চাপ বাড়াতে চাইনা, একজন মানুষের কথা বলতে পারার ক্ষমতার সীমা রয়েছে।” এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে স্বেচ্ছাসেবী ধরে এঁদের সংখ্যা পৌঁছয় ২০০-তে।

এখন এ সংস্থার শাখা প্রশাখা আরও বিস্তৃত হয়েছে, ক্যানসার, হৃৎপিন্ডের অপারেশন, আসামের বাইরে আটকে পড়া কিডনি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টের রোগীদের সাহায্যের জন্য কর্মসূচি রয়েছে, এ ছাড়া আসামের প্রবীণ নাগরিকদের বাড়িতে ওষুধ পৌছনো, এবং মানসিক স্বাস্থ্যে সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য একটি পুরো টিম গঠন করা হয়েছে।

সংস্থার এক কাউন্সেলর সৈয়দ মহিদুল হকের কথায়, “যাঁদের রেজাল্ট নেগেটিভ হওয়ার পর বাড়িতে রয়েছেন, তাঁদের অনেকে বিভিন্ন উপসর্গের কথা কল্পনা করছেন। এঁরা খবর দেখছেন, উত্তেজিত হচ্ছেন, ভাবছেন এঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। এই উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক এবং কীভাবে একে কাটিয়ে উঠতে হবে আমরা সে পরামর্শ দিই। খারাপ সময় যাচ্ছে, আমরা বলি এই সময়ে ইতিবাচক থাকা নিজের পক্ষে এবং চারপাশের মানুষজনের কাছেও কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”

এই কথাটাই তরুণ প্যারামেডিকরা মনে রাখার চেষ্টা করেন কল সেন্টারে। হক ২০১৬ সাল থেকে এই সংস্থার সঙ্গে রয়েছেন, ফিজিওথেরাপির স্নাত কলিতা এখানে যোগ দিয়েছেন গত বছর, খবরের কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে। কিন্তু প্রতিদিন সকালে খালি রাস্তা দিয়ে অফিসে আসার সময়ে তিনি ভাবেন, এটা কোনও “চাকরি” নয়। “মানবজাতির সেবা”।

Assam COVID-19
Advertisment