কাজ করতেন দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ গ্যাস লিমিটেডে। গ্যাসের পাইপলাইন ঠিক করা, গ্যাস স্টোভের দেখভাল, কিংবা গ্যাস লাইন ঠিক করার জন্য রাস্তা খুঁড়ে তার দেখভাল করা। যে সময়ের গল্প, সেটা ২০০৯। পেরিয়ে গেছে দশ বছর, ২০১৯ সালে সেই ছেলেটিই আজ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের (জেএনএসইউ) সভাপতি পদের জন্য। তাঁর নাম জিতেন্দ্র সুনা (২৯)। বিরসা আম্বেদকর ফুলে স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের দলিত পিএইচডি শিক্ষার্থী জিতেন্দ্রর এই লড়াইয়ের নেপথ্য আছে আরেক অক্লান্ত সংগ্রাম।
জন্ম ওড়িশার কালাহান্ডি জেলার পৌড়কেলা গ্রামে। বাল্যকাল থেকেই সংসার চালাতে দিনমজুরির কাজ করতেন জিতেন্দ্র। ছ'ভাই বোনের সংসার চালাতে ১৯৬০ সালে লাগু হওয়া ভূমি সংস্কার আইনের আওতায় পাওয়া এক একর জমিতে চাষাবাদ করতেন, সেই ফসল বাজারে বিক্রি করতেন তাঁর মা। তবে বর্তমানে বন্ধক রয়েছে সেই জমি।
আরও পড়ুন: অসম এনআরসি: কীভাবে দেখবেন নামের তালিকা? জেনে নিন
ছোটবেলার সেই স্মৃতিতে ডুব দিয়ে জিতেন্দ্র বলেন, "আমি যখন ক্লাস এইটে, তখন আমার মা মারা যান। সংসার চালাতে তখন অন্যদের জমিতে বীজ বোয়ার কাজ করতাম। প্রতিদিন ৩০-৪০ টাকা করে পেতাম। এমনকি ১০০ দিনের কাজে রাস্তা এবং পুকুর কাটার কাজও করেছি। সেখানেও ১০০-১৫০ টাকা করে পেতাম প্রতিদিন।" লড়াইটা যে জীবনের শুরু থেকেই চালিয়ে গেছেন জিতেন্দ্র, সেই সুরই বারবার ধরা পড়েছে তাঁর গলায়।
তবে দৈন্যের মাঝে চাপা পড়েনি বিদ্যা। দিনমজুরির কাজ করতে করতেই নিয়মিত স্কুলেও যেত কিশোর জিতেন্দ্র। পরবর্তীতে অর্থনৈতিক সমস্যার কারনেই স্কুলের পড়া শেষ করে দিল্লি পাড়ি দেয় সে। জিতেন্দ্রর কথায়, "আমার দাদা আইজিএল-এ চাকরি করত, তাই আমিও সেখানেই যোগ দিই। বাড়িটা ঠিক করাটা সেই সময় খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।"
তবে এই লড়াইয়ের মাঝেই সামনে আসে আরও এক লড়াই। জিতেন্দ্র বুঝতে শুরু করে, বর্ণবৈষম্যের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী। সেই স্মৃতিকে উস্কে আজ জিতেন্দ্র বলেন, "ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আমাদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করা হতো। আমাদের খেতে দেওয়া হত আলাদাভাবে। বর্ণবৈষম্য সম্বন্ধে ধারণা আরও জোরালো হলো যখন দেখলাম আমার দাদাকে তার পদবি জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, এবং ও কোনও উত্তর দিচ্ছে না।"
জিতেন্দ্র ক্রমশ বুঝতে পারেন যে ইন্দ্রপ্রস্থ গ্যাস লিমিটেডের থেকে পাওয়া মাসিক ৩,৫০০ টাকা দিয়ে রাজধানীতে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠছে, বাড়িতে টাকা পাঠানো দূরস্থান। এরপরই জিতেন্দ্র ঠিক করেন, গ্র্যাজুয়েশন করবেন। সেটাই তাঁর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়। গ্র্যাজুয়েশন করার পর এক বন্ধুর কথামতো নাগপুরে ফ্রি ইউপিএসসি-র কোচিংয়ে ভর্তিও হন। সেই প্রসঙ্গে বলেন, "আমি নাগপুরে পৌঁছে জানতে পারি যে ওটা একটা ১০ মাসের কোর্স, যেখানে আম্বেদকরবাদ এবং বৌদ্ধধর্ম পড়ানো হয়। সেখানেই আমি পড়তে শুরু করলাম কীভাবে বর্ণ ও অস্পৃশ্যতাকে দেখা হয় এই দেশে। তাই আমি সেই ইতিহাস অধ্যয়ন এবং আমাদের (দলিত) ইতিহাস লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
আরও পড়ুন: এইচআইভি ধরা পড়ার আতঙ্কে মৃত মহিলা, ভুল রিপোর্ট, বলল তদন্ত
২০১৩ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন জিতেন্দ্র সুনা। সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোশ্যাল এক্সক্লুশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ পলিসি থেকে ইতিহাসে এমএ এবং পরবর্তীতে এমফিল করেন। বর্তমানে সেখান থেকেই 'হিস্ট্রি অফ আইডেন্টিটিস অ্যান্ড এক্সক্লুশন; আম্বেদকর অ্যান্ড দ্য মার্জিনালাইসড' শীর্ষক পিএইচডি থিসিস লিখছেন এই লড়াকু শিক্ষার্থী।
বিরসা আম্বেদকর ফুলে স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম জিতেন্দ্র বলেন, "আমরা দেখছি যে আরএসএস এবং বিজেপি কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করছে... বাম নেতৃত্বাধীন জেএনএসইউ তাদের বিপক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।" জেএনএসইউয়ের সভাপতি পদের জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম লক্ষ্য হল জেএনইউতে অনুর্ত্তীণদের হার চিহ্নিত করা এবং শিক্ষার্থীদের ফেলোশিপ নিশ্চিত করা। প্রসঙ্গত, আগামী ৬ সেপ্টেম্বর জেএনইউতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সভাপতি পদের জন্য ভোটপর্ব।