ফজলুর রহমান রাজু
বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে ছোঁয়াচে জলবসন্ত (চিকেনপক্স) রোগের প্রকাপ দেখা দিয়েছে। স্থানীয় চিকিৎসক ও উন্নয়নকর্মীদের আশঙ্কা, দ্রুত এই রোগ নিরাময় না করা গেলে মহামারী আকারে ধারণ করতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) তথ্য অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৮৩২ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু চিকেনপক্সে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবসান কমিশনার শামসুল দোহা এই সংখ্যা বর্তমানে ১,০০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেন। একই সাথে জলবসন্তে এক শিশুর মৃত্যুর বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেন।
মহামারী আকার ধারণ করতে পারে ও উন্নয়নকর্মীদের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই আশঙ্কায় প্রতিটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) তাদের কর্মীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে অনুরোধ জানিয়েছে। ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিলের শিশু নিরাপত্তা সহকারী কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, ক্যাম্পে প্রবেশকালে হাতে গ্লাভস ও মুখোশ পরিধান করতে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: কোথায় গেলেন বারুইপুরের রোহিঙ্গারা?
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন মোঃ আবদুল মতিন জানান, উখিয়া-টেকনাফে ৩০টি শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে একের পর এক রোগজীবাণু ধরা পড়ছে। মারণব্যাধি এইডস্ ও ডিপথেরিয়া সহ নানা ছোঁয়াচে রোগের পর এবার জলবসন্ত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১,০০০-এর বেশি রোহিঙ্গা, বলেন মতিন। তিনি আরো জানান, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন মেডিক্যাল সেন্টারে রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় স্থানীয়দের সাবধানতা অবলম্বন করতে অনুরোধ করেছেন তিনি।
মতিন বলেন, এটা একটি খুবই ছোঁয়াচে রোগ। এ রোগে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় প্রায় একটানা এই অস্বস্তিকর অবস্থা থাকে। উন্নয়ন সংস্থা ও সিভিল সার্জন অফিসের মতে, শিবিরগুলিতে রোহিঙ্গারা একই ঘরে অনেকে বাস করেন। পরিবেশও ভয়াবহ। এমন পরিবেশে পরিবারের একজনের এই রোগ হলে সবার হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। ফলে সমগ্র শিবিরে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তো আছেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, চিকেনপক্সে আক্রান্তদের মধ্যে ৩৯ শতাংশের বয়স পাঁচ বছরের কম। আর এ রোগের বিস্তার ঠেকাতে কক্সবাজার জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যাম্পগুলিতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সংক্রামক এই রোগের খবর শিবিরের বাইরে আসার কারণে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। তাই রোহিঙ্গাদের জনবিচ্ছিন্ন এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
তবে জেলা সিভিল সার্জন আরও বলেন, সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় (এমওএইচ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্য স্বাস্থ্য খাতের অংশীদাররা প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য উখিয়া-টেকনাফে পৃথক প্রশিক্ষণ শুরু করছে।
মায়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে নিজেদের দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে আন্দাজ ১২ টি ভয়াবহ রোগ ছড়িয়েছে বলে মনে করছে সিভিল সার্জন অফিস। ইতিমধ্যে গত এক বছরে ৭০ জনের মতো ডিপথেরিয়া রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেছেন বলে জানান বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলির প্রধান সমন্বয়ক সিরাজুল হক খান।
আরও পড়ুন: আড়াই দিন পরেও কাটেনি জট, ত্রিপুরায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গারা
কক্সবাজার সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গারা শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, গর্ভকালীন জটিলতা, টিউমার, পিত্তথলির সমস্যা, জন্ডিস, রক্ত সঞ্চালনে বাধা, জলবাহিত রোগ, হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি বা এইডস রোগে আক্রান্ত। গত এক বছরে কক্সবাজার সদরে ৪,৮৯৫ জনকে এসব রোগের জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ারসের (এমএসএফ) তথ্যানুসারে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলিতে তারা প্রতি মাসে গড়ে ৬৫,৬৩৯ জনকে চিকিৎসা দিচ্ছে। এর মধ্যে গড়ে ৬,১২৫ জনই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ২৮৫ জন ভয়াবহ এইচআইভিতে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন আবদুল মতিন।