নারী শরীরে স্বল্প কাপড়, জীবন্ত স্ট্যাচু হয়ে চার দশক পার
"আজও আমাদের পরিবারের কেউ জানে না আমি শিল্পীদের মডেল হিসাবে কাজ করি। তবে এই পেশাকে সম্মান করি। কিন্তু আমাদের পরিবার বা সমাজের একটা বড় অংশ এখনও এই পেশাকে অন্য় নজরে দেখে।"
"আজও আমাদের পরিবারের কেউ জানে না আমি শিল্পীদের মডেল হিসাবে কাজ করি। তবে এই পেশাকে সম্মান করি। কিন্তু আমাদের পরিবার বা সমাজের একটা বড় অংশ এখনও এই পেশাকে অন্য় নজরে দেখে।"
এলোকেশী, শরীরে আলতো কাপড়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই ভাবে স্ট্যায়াচু হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে বা কখনও বসে। যতক্ষণ না পর্যন্ত শিল্পীর শিল্পসত্ত্বা পূর্ণ বিকশিত হচ্ছে, ততক্ষণই একইভাবে থাকতে হয়। এই 'লাইভ মডেল' ছাড়া শিল্প শিক্ষার ভিত পোক্ত হয় না। তাঁদের পাঠক্রমের সেমিস্টারও সম্পূর্ণ হয় না। আর এরপর পাশ করা শিল্পী হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও অনেকেই বেমালুম ভুলে যান এঁদের। এদিকে, জীবনভর এই মডেলদের অধিকাংশের নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা চলতেই থাকে।
Advertisment
এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অধ্যাবসায় চলতে থাকে। ছবি- শশী ঘোষ
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। তাই এই পেশায় থাকা তাঁদের কাছে বাধ্যতামূলক। অথচ, সন্তানও জানে না, স্বামীও জানেন না। মডেলদের পেশার কথা জানেন না কোনও প্রতিবেশীও। চক্ষু লজ্জার ভয়ে ৪৫ বছর ধরে অবগুণ্ঠনের মধ্যেই শিক্ষানবিশ শিল্পীদের মডেল হিসাবে কাজ করছেন সুনন্দা রায় (নাম পরিবর্তিত)। বছর কুড়ি ধরে তাঁর সঙ্গে একই পেশায় রয়েছেন মেয়েও। এখন মা-মেয়েই শুধু জানেন তাঁদের এই পেশার কথা।
Advertisment
জীবন্ত স্ট্যাচু। ছবি- শশী ঘোষ
৬৫ বছরের সুনন্দাদেবী জানাচ্ছেন, কীভাবে তিনি মডেল হয়েছিলেন। ৪৫ বছর ধরে এই ভাবে রোজগার করে সংসার টেনেছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছেন। উত্তর ২৪ পরগণার মছলন্দপুর থেকে প্রতিদিন কলকাতায় এসেছেন। এখনও আসেন। একসময় দিন-রাত কাজ করেছেন। অনেক দিন হল কাজের ভার কমে গিয়েছে। কোনওরকমে দিন গুজরানই চলে। সুনন্দাদেবীর বক্তব্য, "আজও আমাদের পরিবারের কেউ জানে না আমি শিল্পীদের মডেল হিসাবে কাজ করি। তবে এই পেশাকে সম্মান করি। কিন্তু আমাদের পরিবার বা সমাজের একটা বড় অংশ এখনও এই পেশাকে অন্য় নজরে দেখে। তাই বাড়িতে কখনও বলবার সাহস পাইনি। পরিবারের লোকেরা জানে আর্ট কলেজে কোনও একটা কাজ করি। আমার এক মেয়েও এই পেশায় এসেছে। তাঁর স্বামী বা সন্তানেরাও কেউ পেশার কথা জানে না।"
রোজগারের হাল কেমন? সুনন্দাদেবী বলেন, "একটা সময় প্রচুর কাজ ছিল। আয়পত্তরও ভালই ছিল। কিন্তু এখন কাজের বাজার একেবারে ভাল নয়। প্রায় তলানিতে। মাসে হাতে গোনা কয়েকটা কাজ হয়। একটাই খুশির বিষয় এবার প্রতিক্ষেত্রে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা হচ্ছে। তবে কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্র-ছাত্রীরা নানা ভাবে সাহায্য করেন।"
এই মডেল ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না ফাইন আর্টের পাঠক্রম। ছবি- শশী ঘোষ
সুনন্দাদেবীর স্মরণে আছে ৪৫ বছর আগের ঘটনা। বললেন, "রোজ কলকাতায় আসতাম। একদিন এক ব্যক্তি ডেকে বললেন কাজ আছে। করবে? কাজটা শুনে প্রথমে কিন্তু কিন্তু করছিলাম। প্রথমে একটু আধটু ভেবেছিলাম। পরে ভাবলাম কাজটা ভাল। করা যেতেই পারে। সেই শুরু। দিনরাত এক করে কাজ করতাম। এই ভাবেই পেরিয়ে গেল ৪৫ টা বছর।" মেয়ে বাসন্তী (নাম পরিবর্তিত) বলেন, "আমিও শেষমেশ এই পেশাতেই এলাম। তা-ও ২০ বছর হয়ে গিয়েছে। প্রথম দিকে কাজের অভাব ছিল না। এখন কিন্তু সেই কাজ আর নেই। আমি পেশাটাকে পছন্দ করি। কিন্তু আমার স্বামী বা সন্তানেরা জানেন না যে আমি প্রকৃত কী কাজ করি। ছেলে-মেয়েরা কলেজে এসে ঘুরেও গিয়েছে। তারা এটা জানে যে মা ভাল কোনও কাজের সঙ্গেই যুক্ত। তবে সরকার যদি আমাদের দিকে একটু নজর দিত তাহলে ভাল হত। আর্থিক অনটনের কিছুটা রেহাই হত। এখন যে সেমিস্টার অনুযায়ী কাজ করি তা কোর্সে বাধ্যতামূলক থাকলেও কাজ অনেক কম হয়। যাক কী আর করা যাবে।"
আর্ট কলেজের ক্যানভাস। ছবি- শশী ঘোষ
দমদমের সরকার পোষিত আর্ট কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক অভীক দেবনাথ বলেন, "এটা সত্যি যে এই মডেলদের ছাড়া আর্টের কোনও ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে না। পোট্রেট বা হিউম্যানের ওপর আর্ট শিখতে হলে মডেলের অনুকরণ করতেই হবে। এঁদের আরও সুযোগ-সুবিধা দিলে ভালই হয়।" আর্টের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী অর্পিতা দাসের কথায়, "এঁরাই আমাদের আর্টের ভিত্তি স্থাপন করে দেন। এই মডেলরাই আমাদের ভরসা।"
আলো-আঁধারিতেই জীবন কেটে যায় ফাইন আর্টের মডেলদের। ছবি- শশী ঘোষ
আর্ট কলেজের অধ্যাপক কল্লোল কুমার রায়ের মতে, "এই মডেল ছাড়া অ্যানাটমির লাইফ স্টাডি করা সম্ভব নয়। মুখের প্রতিচ্ছবি, পোট্রেট সবেতেই এই মডেলরাই ছাত্র-ছাত্রীদের ভরসা। তবে এদের প্রতি সরকার নজর দিলে ভাল হয়।"