Advertisment

'আহতদের রক্তে জামাকাপড় লাল হয়ে গেছে', অভিশপ্ত রাতে জারি ছিল প্রাণপণ লড়াই

শিশুদের আগলে রাখা থেকে আহতদের সেবা, সারারাত উদ্ধারে প্রাণপাত করেছেন বাস্তবের এই নায়করাই

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
balasore, Coromandel express accident, Odisha train accident, Odisha train derailment, Shalimar Chennai Coromandel Express derailment, indian express"

রেলস্টেশনের দিকে বিকট শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা ধরেই নিয়েছিলেন বড় কিছু একটা ঘটেছে। স্টেশনের দিকে ছুটে আসেন সকলে। এসেই দেখেন বুক ফাটা কান্না, হাহাকার। ভর সন্ধ্যায় চোখের সামনে এত মানুষকে কাতরাতে দেখে কী করবেন তা ভেবে উঠতেই কিছুটা সময় চলে যায়। কিছুক্ষণ যেতেই মনকে শক্ত করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া। এ এক অন্য রকমের চ্যালেঞ্জ। কেউ বাচ্চাদের সামলেছেন। কেউ আহতদের মুখে জল তুলে দিয়েছেন। কেউ আবার বন্ধ ওষুধের দোকান খুলে যাবতীয় ওষুধপত্র নিয়ে ছুটে গিয়েছেন দুর্ঘটনাস্থলে। কিছু মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ট্রেন দুর্ঘটনায় অনেকেই জীবন ফিরে পেয়েছেন।

Advertisment

ওড়িশার বেহনাগা বাজার স্টেশনে গত দুই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। তিনটি ট্র্যাকে তিনটি ট্রেনের ভয়াবহ সংঘর্ষে প্রায় ২৮৮ জন যাত্রী ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত হাজারের বেশি যাত্রী। দুর্ঘটনা এতটাই মারাত্মক ছিল যে ট্রেনের বগিগুলো লাইন থেকে ছিটকে পড়ে। রেলস্টেশনের দিকে বিকট শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের বাসিন্দারা স্টেশনের দিকে ছুটে আসেন। চোখের সামনে যা দেখলেন তাতে হতবাক সকলেই। এই সংকটের সময় বীরের মত লড়াই করেছেন ওরা। পাশে থেকেছেন আহতদের। সাহস জুগিয়ে গিয়েছেন। কেউ বিনামূল্যে জল ও খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, অন্যরা শিশুদের দেখাশোনা করেছেন। কেউ কেউ বিনামূল্যে ইনজেকশন ও ওষুধ এনে দিয়েছেন। আসুন জেনে নিই পর্দার পিছনে থাকা বাস্তবের নায়কদের।

দুর্ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরে থাকেন বছর ২৫-এর সৌভাগ্য। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান তিনি । তার নিজস্ব ওষুধের দোকান আছে। শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি বলেন, “আমি একটা বিকট আওয়াজ শুনে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি উলটে পড়ে রয়েছে ট্রেনের বগিগুলি। চারিদিকে হাহাকার, কান্নার রোল। লোকজনকে উদ্ধার করে আমার দোকানের কাছে নিয়ে আসা হয়। আমি তাদের টিটেনাস ইনজেকশন এবং ব্যথা দূর করার ট্যাবলেট ও মলম দিই। অনেকের শরীর থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। ব্যান্ডেজ ও অন্যান্য ওষুধও দিয়েছি। আমি ভোর চারটে নাগাদ বাড়ি যাই। সেই ভয়াবহ স্মৃতি আমাকে ঘুমের মধ্যেও যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে।" ওষুধ বাবদ প্রায় আট হাজার টাকা খরচ হয়েছে কিন্তু আহতদের কাছ থেকে এক টাকাও নেননি তিনি। কেন? প্রশ্ন শুনে অঝোরে কেঁদে ফেলে তিনি পালটা উত্তর দেন, 'আচ্ছা দাদা আমি কি মানুষ নই?'

দুর্ঘটনাস্থলের খুব কাছেই থাকেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী নীলাম্বর বেহেরা। তিনি বলেন “আমরা একটি বিকট শব্দ শুনে বাইরে দৌড়ে গেলাম। আমরা যা দেখেছি তা বর্ণনা করতে পারব না। লোকজনের হাহাকার। সাহায্যের জন্য চিৎকার। আমরা সাহায্যের জন্য ছুটে যাই। " দুর্ঘটনায় আহত ৫০ শিশুকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি। তাদের মুখে তুলে দিয়েছেন খাবার ও পানীয়। শিশুরা অধিকাংশই পাটনার বাসিন্দা। পরদিন সকাল পর্যন্ত তারা আমাদের বারান্দায় ছিল। এর পরে, আমরা তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছি", বলেন বেহরার স্ত্রী রিনামনি।

একই ট্রেনে বহেরার ছেলের দুই বন্ধুও ছিল। এই বন্ধুদের ফোন পাওয়া মাত্রই চন্দন কুমার ঘটনাস্থলে যান। চন্দন কুমারের দ্রুত পদক্ষেপ উভয়ের জীবন রক্ষা করে। শুধু তাই নয়, সেখানে আটকে পড়া অনেককে বের করে আনেন তিনি। চন্দন কুমার বলেন, 'উদ্ধার করতে গিয়ে চোট লাগে আমার পায়েও'।

বহেরা পরিবারের পাশেই থাকেন থাকা ঝুলন দাস। তিনি আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ১২ বছরের ছেলেও হাত লাগায় উদ্ধারকার্যে। ঝুলন জানিয়েছেন, “আহতদের মধ্যে অনেকেই আমাদের বাড়ির কাছে জড়ো হয়েছিল। আমি ও আমার ছেলে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। তাদের জন্য জল ও খাবারের ব্যবস্থা করি। আহতদের আত্মীয়দের ফোন করে ঘটনার কথা জানাই"।
ঘটনাস্থল থেকে ৫০ মিটার দূরে অবস্থিত লক্ষ্মী স্টোরের মালিক মহেশ গুপ্ত। একটি মুদি দোকানের মালিক। আহতদের বিনামূল্যে জল ও খাবার দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে উদ্ধার অভিযান চালাতে দোকান বন্ধ করে দেন তিনি। কিন্তু পরে জল ও খাবারের ব্যবস্থা করতে গভীর রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন বলে জানান তিনি।

সৌম্যরঞ্জন গুপ্তার দোকান থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে থাকেন, তিনিও এই সময়ে এগিয়ে আসেন আর্তদের পাশে। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “লোকেরা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। আমরা লোহার রড নিয়ে জানালা ভেঙে ভিতরে আটকে থাকা অনেককেই বের করেছি। তাদের মধ্যে দুজন আমার কাঁধে মাথা রেখে মারা গেছেন। আমি তাদের রাস্তার পাশে রেখে আবার ফিরে এসে উদ্ধারকার্যে হাত লাগাই”, ।

প্রতিবেশী লিলি হাঁসদা, তিনি উদ্ধার অভিযানে সাহায্যর হাত বাড়িয়েছেন। তিনি জানান, "আমরা যতটা সম্ভব মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। অনেক আগেই মারা গিয়েছিল। অনেকের হাত-পা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। আমরা সকাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেছি", । "পুলিশ এবং সরকারী উদ্ধারকারী দল অনেক পরে এসেছিল আহতদের রক্তে আমার জামাকাপড় লাল হয়ে গেছে," ।

coromandel express accident
Advertisment