কলকাতা মেডিক্য়াল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শহরে বিপর্যয়ের এক মাসের বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। ৪ সেপ্টেম্বর মাঝেরহাট সেতু ভাঙ্গা দিয়ে শুরু হয়েছিল। তারপর একের পর এক দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত হয়েছে মহানগর। শহরের বাইরে উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে দাড়িভিট হাইস্কুলে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই ছাত্রের মৃত্যু হয় ২১ এবং ২২ সেপ্টেম্বর। পাঁচটি ঘটনার কোনওটারই রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি এখনও। আদৌ দোষীরা সাজা পাবে কী না, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়ে।
৪ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪.৪০ নাগাদ মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ে। তখন ওই সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াত করছিল বাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল সহ বিভিন্ন যানবাহন। দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আপাতত চার, আহত বেশ কয়েকজন। দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে শুরু হয়ে যায় চাপান-উতোর। কলকাতার সঙ্গে বেহালা অঞ্চলের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কেন সেতু ভেঙে পড়েছে? তদন্তের আগেই অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ শুরু হয়ে যায়। যদিও রাজ্য সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করে। শুরু হয়ে যায় রাজ্যের অন্যান্য সেতুর পর্যবেক্ষণ। কিন্তু এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘাড়ে এসে পড়ে বাগরি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ড।
১৬ সেপ্টেম্বর রবিবার ভোর রাতে আগুন লাগে বড়বাজারের বাগরি মার্কেটে। বা বলতে পারেন, শনিবার রাত আড়াইটে নাগাদ। চারদিনের বিধ্বংসী আগুনের পর দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে সর্বনাশের মুখে কয়েক হাজার পরিবার। দমকল মন্ত্রী স্বীকার করে নেন, অগ্নিনির্বাপনের কোনও ব্যবস্থা ছিল না ওই বাজারে। তবুও ফায়ার লাইসেন্স ছিল। কেন ছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখনও বড়বাজারের অলিতে গলিতে ঘুরছে প্রশ্ন, কেন শুধু ছুটির দিনেই আগুন লাগে বড়বাজারের মার্কেটে? এরও কোনও জবাব মেলেনি।
বিপর্যয় তিন। ২০ সেপ্টেম্বর উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিট গ্রামের স্কুলে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমার বাঁধে। বিক্ষোভের জেরে গুলিতে মৃত্যু হল দুই প্রাক্তন ছাত্রের, হাঁটুতে গুলি লাগে এক বর্তমান ছাত্রের। অভিযোগ, পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে ওই দুজন। এখনও এই ঘটনা নিয়ে উত্তপ্ত দাড়িভিট। গ্রামবাসীদের একটাই দাবি, ঘটনার সিবিআই তদন্ত হোক। আরএসএস-বিজেপি রয়েছে ঘটনার পিছনে, অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী। পাল্টা আদালতে মানহানির মামলা করে গেরুয়া বাহিনী, এবং ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলা বনধ ডাকে বিজেপি। রাজ্যের বহু এলাকা উত্তপ্ত থাকে দিনভর।
দুর্ঘটনা চার। ২ অক্টোবর দমদমের কাজিপাড়ায় সাতসকালে ফলের দোকানের সামনে বিস্ফোরণ। এই ঘটনায় মৃত্যু হয় আট বছরের এক শিশুর। জখম হন ১১ জন। এলাকায় অাতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু তার চেয়েও দ্রুত ছড়ায় রাজনৈতিক বাদানুবাদ এবং পরস্পর দোষারোপের পালা। ঘটনার তদন্ত করছে সিআইডি। তবে এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
ঘটনা নম্বর পাঁচ। ৩ অক্টোবর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আগুন। এখানেও আগুন লাগে সাতসকালেই। ফার্মাসি পুড়ে ছাই। ধোঁয়ার কবল থেকে রক্ষা পেতে রোগী এবং কর্মীদের দৌড়ঝাঁপ হাসপাতাল জুড়ে। অভিযোগ, এর ফলে এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আগুনের উৎসের অনুসন্ধান করছে ফরেন্সিক বিভাগ। তবে এখনও কারণ জানা যায়নি। কেন আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না, তারও কোনও সদুত্তর মেলেনি।
পাঁচটি ঘটনার কোনোটিতেই এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে বিরোধী দলগুলির অভিযোগ। কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, "তদন্ত শুরু করার অাগেই তদন্তের গতিপথ বাতলে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সে মাঝেরহাট সেতু হোক বা দাড়িভিটে গুলিতে মৃত্যু। এখন পর্যন্ত একটা ঘটনারও কিনারা হল না। বরং তদন্ত ভুল পথে চালনা করা হচ্ছে।"
বাগরি অগ্নিকাণ্ডে অভিযুক্ত রাধা বাগরি, বরুণ বাগরি, এবং কৃষ্ণকুমার কোঠারি ফেরার হয়ে আছেন। মাঝেরহাটের ঘটনায় এখনও কেউ দায় স্বীকার করে নি। দাড়িভিটের ঘটনায় গ্রামবাসীরা গ্রেপ্তার হলেও কে গুলি চালালো জানা যায় নি। ঘটনার পরই প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছিল, পুলিশের গুলি নয়। তাহলে দিনদুপুরে কে চালালো গুলি? দমদমের বিস্ফোরণে কী বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে? তারও তদন্ত চলছে। তবে কেউ এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। মেডিক্যাল কলেজে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা না থাকার দায় কার বা কাদের? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও ইঙ্গিত নেই।
৩০ দিনে পাঁচটি বিপর্যয়। মৃত মাঝেরহাটে চারজন, দাড়িভিটে দুজন, দমদমে একজন এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন। বাগরিতে কারও প্রাণনাশ না হলেও সর্বনাশ ঘটেছে। বিরোধীদের অভিযোগ, এই সব বিপর্যয়ের পরও সরকারে কোনও হেলদোল নেই। শুধু দোষীদের আড়াল করার প্রচেষ্টা চলছে।
দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনায় একটি আরেকটিকে চাপা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দাড়িভিটের ঘটনা নিয়ে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতির কাছেও দরবার করেছেন মৃত দুই যুবকের পরিবার। ৬ তারিখও ইসলামপুরে সভা করেছে বিজেপি। এখনও খোলে বি দাড়িভিট হাইস্কুল। ইতিমধ্যে সিআইডি ঘটনার তদন্ত শুরু করছে। কিন্তু যেই তদন্ত করুক, প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়বে কি?