২৬ নভেম্বর ২০০৮ সন্ধ্যা পর্যন্ত, মুম্বই প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক ছন্দে চলছিল। বাজারগুলোতে মানুষজনের উপচে পড়া ভিড়। মেরিন ড্রাইভেও তখন থিকথিক করছে ভিড়। কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুম্বইয়ের রাস্তায় হৈচৈ পড়ে যায়।
জইশ-ই-মহম্মদের ১০ জন সন্ত্রাসবাদী হামলা চালায় বাণিজ্যনগরীতে। মুহূর্তেই হুলস্থূল পড়ে যায়। এই সন্ত্রাসবাদী হামলার ১৪ তম বর্ষপূর্তিতে বুকে পাথর চেপে সেদিনের হামলা স্মরণ করছে সারা দেশ। ভারতীয় ইতিহাসের সেই কালো দিন যা কেউ চাইলেও ভুলতে পারে না। সেদিনের সেই হামলায় ১৬০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ৩০০ জনের বেশি আহত হন।
হামলার তিন দিন আগে অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর এই সন্ত্রাসবাদীরা করাচি থেকে সমুদ্রপথে একটি বোটে মুম্বই পৌঁছায়। যে নৌকা করে জঙ্গিরা এসেছিল সেটিও ছিল একটি ভারতীয় বোট। বোটে থাকা চার নিরীহ ভারতীয়কে হত্যা করে সেই বোট দখল করে জইশ জঙ্গিরা। রাত ৮টা নাগাদ জঙ্গিরা কোলাবার কাছে কাফ প্যারেডের মাছের বাজারে নামে।
এখান থেকে তারা চারটি দলে ভাগ হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। জঙ্গিরা মাছের বাজারে নামলে সেখানকার জেলেদেরও তাদের দেখে সন্দেহ হয়। তথ্য অনুযায়ী, জেলেরা স্থানীয় পুলিশকেও এই তথ্য জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাতে খুব একটা আমল দেননি।
আরও পড়ুন: < ২০০২-য়ের দাঙ্গাকারীদের BJP উচিত শিক্ষা দেওয়ায় গুজরাটে শান্তি প্রতিষ্ঠিত: অমিত শাহ >
তখন রাত ৯ টা বেজে ৩০ মিনিট ছত্রপতি শিবাজি রেলওয়ে টার্মিনালে গুলি চালানোর খবর পায় পুলিশ। স্টেশনের প্রধান হলঘরে দুই জঙ্গি নির্বিচারে গুলি চালায় বলে জানা যায়। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন মহম্মদ আজমল কাসাব, ইতিমধ্যেই এই জঙ্গির ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। হাতে AK47 রাইফেল! টানা ১৫ মিনিট ধরে গুলি চালায় ২ জঙ্গি, এই ঘটনায় মুহূর্তেই ৫২ জন নিহত হয় এবং ১০০ জনেরও বেশি আহত হন।
এরপর দক্ষিণ মুম্বাইয়ের লিওপোল্ড ক্যাফেও সন্ত্রাসবাদী হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। মুম্বাইয়ের এই বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় গুলিতে নিহত ১০ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিকও ছিলেন। ক্যাফের দেওয়ালে বুলেটের চিহ্ন এখনও স্পষ্ট।
ঠিক একঘন্টা বাদে রাত তখন ১০টা বেজে ৩০ মিনিট। ভিলে পার্লে এলাকায় একটি ট্যাক্সি বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। এতে চালক এবং একজন যাত্রী নিহত হন। এর ১৫ মিনিটের মধ্যেই বোরিবন্দর থেকে একই রকম বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। মৃত্যু হয় চালক ও দুই যাত্রীর।
ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার গল্প এখানেই শেষ নয়। ২৬/১১ হামলার তিনটি প্রধান ফ্রন্টের মধ্যে মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল, ওবেরয় ট্রাইডেন্ট হোটেল এবং নরিমান হাউস। হামলার সময় তাজ হোটেলে ৪৫০ জন এবং ওবেরয়তে ৩৮০ জন অতিথি ছিলেন। সন্ত্রাসী হানায় কেঁপে ওঠে তাজ হোটেল। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারিদিক। পরে সেই ছবিই সকল গণমাধ্যমে মুম্বই হামলার অন্যতম মুখ হয়ে ওঠে।
হামলার পরের দিন সকালে অর্থাৎ ২৭শে নভেম্বর তাজ হোটেলের সকল বন্দিকে মুক্ত করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেলেও পরে জানা যায় কিছু মানুষ এখনও সন্ত্রাসবাদীদের হেফাজতে রয়েছে যার মধ্যে অনেক বিদেশীও রয়েছে। হামলার সময় হোটেল দুটিকে র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স (RPF), মেরিন কমান্ডো এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড (NSG) কমান্ডো ঘিরে ফেলে। নিরাপত্তা বাহিনী ও জঙ্গিদের মধ্যে এনকাউন্টার চলে তিন দিন ধরে। শুধু ভারতের নয়, সারা বিশ্বের ১২৫ কোটি মানুষের চোখ তাজ, ওবেরয় এবং নরিমান হাউসের দিকে ছিল।
দুই হামলাকারী নরিমান হাউসও দখল করে। সেখানে অনেক মানুষকে বন্দি করা হয়। এরপর এনএসজি কমান্ডোরা নরিমান হাউস মুক্ত করতে অভিযানে নামে। কয়েক ঘণ্টার লড়াইয়ের পর জঙ্গিদের কবল থেকে উদ্ধার করা হয় নরিমান হাউস। এই অভিযানে একজন এনএসজি কমান্ডোও শহীদ হন। ২৯ নভেম্বর সকালের মধ্যে, নয় জঙ্গিকে খতম করা হয় এবং আজমল কাসাব পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সেদিনের সেই হামলায় মৃত্যু হয় ১৬০ জনের বেশি নিরীহ মানুষের।