৭৬ বছরের কিশোর ঝুনঝুনওয়ালা জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন মহাত্মা গান্ধীর বিভিন্ন জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে। ভারতে তাঁর কাছেই গান্ধীর যা কিছু সংগ্রহযোগ্য তার বৃহত্তম সংগ্রহশালা রয়েছে। কেউ কেউ বলে আমি পাগল। ঝুনঝুনওয়ালা নিজে বলেন এ তাঁর জেদ।
মুম্বইয়ের এই সংগ্রাহকের বাড়ির একটা ঘর জুড়ে রয়েছে গান্ধী সংগ্রহ। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল গান্ধীর চিতাভস্ম।
তাঁর কাছে ঠিক কত সংখ্যায় এরকম জিনিস রয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। তাঁর নিজের হিসেবে ১০ হাজারের বেশি। ১ অক্টোবর থেকে ভারত সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রকের উদ্যোগে মুম্বইয়ের ন্যাশনাল গ্যালারি অফ আর্টে শুরু হয়েছে গান্ধীকে নিয়ে এক মাস ব্যাপী প্রদর্শনী। সেখানে নিজের সংগ্রহ নিয়ে হাজির হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাঁকে।ঝুনঝুনওয়ালার কথায়, তিনি সবসময়েই নানা জিনিস সংগ্রহ করতেন। বড় হয়েছেন ডাকটিকিট, কয়েন আর নোট জমিয়ে। পরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী সম্পর্কে তাঁর যখন আগ্রহ জন্মায়, সে সময়ে এই শখটা কাজে লেগে গেল। ১৯৬৯ সালের ২ অক্টোবর, আজ থেকে ৫০ বছর আগে, মহাত্মা গান্ধীর শতবর্ষে বেশ কিছু ডাকটিকিট, নোট ও কয়েন কিনেছিলেন তিনি। সে সময়েই তিনি স্থির করেন, তাঁর সংগ্রহ চলবে ভারতের এই নেতাকে ঘিরেই।
এখন আর ঝুনঝুনওয়ালাকে এসব কিনতে হয় না। তাঁর সংগ্রহশালার খ্যাতির কারণেই, দেশ দেশান্তর থেকে মানুষজন নিজেরাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর হাতে তুলে দেন নিজেদের কাছে থাকা গান্ধী সম্পর্কিত সমস্ত স্মারক। ঝুনঝুনওয়ালা বলছিলেন, "এসব ওঁদের বাড়িতে ছিল, ওঁরা জানেন না এগুলো নিয়ে কী করতে হবে। আর যেহেতু এগুলো গান্ধীর স্মারক, ফলে তাঁরা ফেলেও দিতে পারছিলেন না। সে কারণে এগুলো ওঁরা আমাকে দিয়ে দেন।"
কয়েকদিন আগেই তাঁর সংগ্রহে এসেছে একটি বই। ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে গ্রেভিল ক্রিকেট ক্লাবে গান্ধীর একটি ছবি আছে এই বইয়ে।
গান্ধী নিয়ে তাঁর আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকেন তিনি। "কারণ তাঁর অহিংসার পথ। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন।"
"স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্য নেতারা, আমার মনে হয় ভাবতেও পারেননি যে অহিংসার পথে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা সম্ভব।" গান্ধীর মূল্যবোধই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। যে কারণে মৃত্যুর ৭১ বছর পরেও তাঁকে কেউ ভোলেনি।
ঝুনঝুনওয়ালার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে স্মারক রয়েছে, তা হল গান্ধীর লেখা ৬০ টি চিঠি। ইংরেজি, হিন্দি ও গুজরাটি ভাষায় লেখা এ চিঠি গুলির মধ্যে একটি টাইপরাইটারে টাইপ করা, অন্যগুলি হাতে লেখা। কোনও চিঠি তিনি লিখেছিলেন ডারবান থেকে, কোনওটা জোহানেসবার্গ থেকে, কোনওটা সবরমতি, বা কলকাতা বা দিল্লি থেকে।
আরেকটি মহামূল্যবান সংগ্রহ হল তাঁর হাতের ছাপ, যার পাশে তাঁর স্বাক্ষর রয়েছে। সেখানে রয়েছে তাঁর হাতে লেখা বাণী, ১২ অগাস্ট, ১৯৪৬ তারিখে।
তুমি কী করছ সেটা বড় কথা নয়
কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ হল
তুমি তা কীভাবে করছ।
কলকাতার এক বন্ধু ঝুনঝুনওয়ালাকে এই হাতের ছাপটা উপহার দিয়েছিলেন। ঝুনঝুনওয়ালার অন্যতম ফেবারিট বাণীর মধ্যে এটি অন্যতম। গান্ধীর চিতাভস্মও তিনি উপহারই পেয়েছিলেন।
২০১৬ সালে ঝুনঝুনওয়ালার সংগ্রহের কথা জানতে পারেন মুম্বইয়ের বাসিন্দা রাজীব গাডেকর। ১৯৪৮ সাল থেকে গাডেকর পরিবারে কাছে গান্ধীর চিতাভস্ম ছিল। গাডেকররে বাবা গান্ধীপুত্র রামদাস গান্ধীর সঙ্গে টাটা অয়েল মিলসে কাজ করতেন। রামদাসই গান্ধীর চিতাভস্ম গাডকরের বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে চিতাভস্ম ছিল গাডেকরের বাড়িতেই। রাজীব গাডেকর ছেলেবেলায় গান্ধীর বাড়িতেও গিয়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন।
"সম্প্রতি আমরা এই চিতাভস্ম নিয়ে কী করা যায় তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করি। বললেন গাডেকর। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু আমরা এ নিয়ে পরিবারের মধ্যে কখনও কোনও আলোচনা করিনি।"
গান্ধীর চিতাভস্ম যে গাডেকর পরিবারের কাছে রয়েছে, সে কথা বিশেষ কেউ জানতেনও না। তিনি সে সব কখনও প্রকাশ্যে রাখেনও নি। কার কাছে চিতাভস্ম দেওয়া যায় সে কথা ভাবতে ভবাতেই এক আত্মীয়ের সূত্রে ঝুনঝুনওয়ালার খোঁজ পান তিনি। আমার মনে হয়েছিল, ঝুনঝুনওয়ালা সত্যিকারের সংগ্রাহক। অন্য যে কেউ এ নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করত।
ঝুনঝুনওয়ালার মনে পড়ে, ১৫ বছর বয়সে নিজের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে গান্ধীর একটি বাণী পড়েছিলেন তিনি, "পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়। এরপর থকে আমি এরকম বাণী খুঁজতে শুরু করি।" এখন জীবনের অর্ধেক কাটানোর পর, তাঁর সংগ্রহে রয়েছে গান্ধীর নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র। তার মধ্যে রয়েছে বোতাম, বুকমার্ক, বাসনপত্র, ঘর সাজানোর জিনিস।
একদিকে পারিবারিক ব্যবসা, অন্যদিকে নিজের খরচে এই সংগ্রহশালা বানানো, ভারসাম্য বজায় রেখে চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। এ কোনও ইনভেস্টমেন্ট নয়, তাঁর কথায়। কারণ এ ইনভেস্টমেন্টের মধ্যে বাণিজ্য থাকে, গান্ধী সংগ্রহ ঝুনঝুনওয়াালর প্যাশন, ভালবাসা।
মিউজিয়ম বানানোর মত অর্থ তাঁর নেই। ঝুনঝুনওয়ালা বলছিলেন, "কেউ যদি আমাকে টাকা দেয়, তাহলে আমি মিউজিয়ম বানাব। আমি ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সংগ্রহ করে চলেছি, আমি এমন ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে চাই যাতে মানুষ এসে দেখতে পারে"। কিন্তু যদি টাকা না পান, তাহলে তাঁর অন্য পরিকল্পনা রয়েছে। "আমি ভারতে ও বিদেশের মিউজিয়মের কাছে এগুলো বিক্রি করে দেব। বিদেশে এসবের বেশি মূল্য রয়েছে বলে আমার মনে হয়।"
তাঁর এই সংগ্রহ নিয়ে ভারত সরকারের ঔদাসীন্যে দুঃখিত ঝুনঝুনওয়ালা। বছরের পর বছর ধরে তিনি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকে চিঠি লিখে গিয়েছেন, জবাব পাননি। এ বছরই প্রথম প্রদর্শনীতে যোগ দিতে বলা হয়েছে তাঁকে। "অনেকেই ভাবে আমার সংগ্রহশালা মানে অনেক টাকার ব্যাপার। তা ঠিক নয়। আমি সারাদিন গান্ধীর কথা ভাবি। তিনি আমাকে ঘিরে থাকেন।"