গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকারীদের আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কর্নাটক শিক্ষা দফতরের যে কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যুক্তিবাদী কর্মী নরেন্দ্র দাভোলকরকে খুন করার জন্য ট্রেনিংও সে-ই দিয়েছিল। বিশেষ তদন্তদল সূত্রে এ কথা জানা গেছে।
৫০ বছর বয়সী রাজেশ বাঙ্গেরাকে গত ২৩ জুলাই গ্রেফতার করা হয়। লেখক ও যুক্তিবাদীদের হত্যা করার জন্য গোপন দক্ষিণপন্থী সংগঠন যেসব যুবকদের নিয়োগ করেছিল, রাজেশ তাদের অস্ত্রপ্রশিক্ষক ছিল বলে জানা গিয়েছিল আগেই। নরেন্দ্র দাভোলকরা হত্যা মামলায় এ সপ্তাহে সিবিআই শচীন আনধুরে এবং শরদ কালাসকরকে গ্রেফতার করে। বিশেষ তদন্ত দল সূত্রে জানা গেছে, এই দুজনকেও অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিল রাজেশ বাঙ্গেরা।
পুণেতে ২০১৩ সালের ২০ অগাস্ট নিহত হন নরেন্দ্র দাভোলকর। সেই হত্যামামলায় ধৃত শচীন আনধুরে ও শরদ কালাসকর ফোটো দেখে রাজেশ বাঙ্গেরাকে চিহ্নিত করে জানিয়েছে, এই ব্যক্তিই তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং দিয়েছিল।
দাভোলকর হত্যা মামলায় ধৃত শচীন আনধুরে ও শরদ কালাসকর এবং গৌরী লঙ্কেশ হত্যা মামলায় ধৃত পরশুরাম ওয়াগমারে ও গণেশ মিসকিনের কাছ থেকে জানা গেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, ২০১১-১২ সাল থেকে চলছে বাঙ্গেরার ট্রেনিং। ইতিমধ্যে অন্তত ৫০ জনকে খুন করার ট্রেনিং দিয়েছে সে। শুধু আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার নয়, শারীরিক আক্রমণের প্রশিক্ষণও দিত রাজেশ বাঙ্গেরা। এর পুরোটাই ছিল উগ্রহিন্দুত্বের ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ছিল দেশ জুড়ে প্রগতিশীল চিন্তাবিদদের উপর আক্রমণ হানা, এমনটাই জানিয়েছে বিশেষ তদন্তদল সূত্র। জানা গেছে রাজেশ বাঙ্গেরার নিজের দুটি লাইসেন্সড পিস্তল ছিল। শুধু তাই নয়, কারাটেতে ব্ল্যাক বেল্টও ছিল সে।
আরও পড়ুন, গৌরী লঙ্কেশ হত্যাতদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য: বুদ্ধিজীবীদের খুন করতে ২২ জনকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ
বিশেষ তদন্তদলের অভিযোগ, শুধু মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটকেই নিযুক্ত কয়েক ডজন লোককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে রাজেশ বাঙ্গেরা। এদের নিয়োগ করেছিল হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির পুণের প্রাক্তন আহ্বায়কস অমোল কালে। অমোল কালেই গোপন কর্মী সংগঠনের মাথা বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। সে নরেন্দ্র দাভোলকর হত্যা মামলাতেও যুক্ত বলে অভিযোগ।
বিশেষ তদন্তদলের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও তথ্য। জানা গেছে, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে বামপন্থী চিন্তাবিদ গোবিন্দ পানসারে হত্যা, এবং ওই বছরেরই অগাস্টে ধারওয়াড়ে এম এম কালবুর্গীর হত্যা, এই দুটি কাণ্ডেই যুক্ত দুটি পৃথক শুটার দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল রাজেশ বাঙ্গেরা। গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে এবং এম এম কালবুর্গী, চারজনের হত্যাকাণ্ডেই বুলেটের জোগান দিয়েছিল এই সরকারি কর্মী, এমনটাই সন্দেহ করা হচ্ছে।
রাজেশ বাঙ্গেরার সোশাল মিডিয়ার প্রোফাইল তার সঙ্গে উগ্র দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী সনাতন সংস্থার যোগাযোগের ইঙ্গিতবাহী। বিশেষ তদন্তদল সূত্রে জানা গেছে, সনাতন সংস্থার শুরুর দিকের সশস্ত্র এবং শারীরিক যুদ্ধ প্রশিক্ষণের শিবিরে যোগ দিয়েছিল সে। ২০১১-১২ সালে, সনাতন সংস্থার প্রাক্তন কর্মীদের নিয়ে যখন গোপন সংগঠন কাজ শুরু করে, তখন থেকে রাজেশ নিজেই প্রশিক্ষকের ভূমিকা নেয়।
আরও পড়ুন, Gauri Lankesh: প্রসঙ্গ গৌরী লঙ্কেশ, একটি খোলা চিঠি
বিশেষ তদন্তদল সূত্রে আরও জানা গেছে, রাজেশ মূলত প্রশিক্ষকের ভূমিকাই পালন করত। বিভিন্ন জায়গায় শিবির পরিচালনা করত সে। তার মধ্যে যেমন ভরত কুরনের বেলগাভির সব্জি ফারম ছিল, তেমনই ছিল সামপাঞ্জে, মেডিকেরি, কর্নাটকের ম্যাঙ্গালোরের মত জায়গাও। অমোল কালের নিয়েগ করা যুবকদের প্রশিক্ষিত করে তোলাই ছিল তার মূল কাজ। তবে গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডে তার ভূমিকা ছিল আরও প্রত্যক্ষ, জানিয়েছে বিশেষ তদন্ত দল সূত্র।
অমোল কালে গ্রেফতার হওয়ার পর, তার জিম্মা থেকে যে ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে দেখা গেছে বাঙ্গেরাকে ‘স্যার’ বলে রেফার করা হয়েছে। ওই ডায়েরির সূত্র ধরেই প্রায় দু মাস পর জুলাইয়ে রাজেশ বাঙ্গেরার নাগাল পাওয়া যায় বলে বিশেষ তদন্ত দল সূত্রে জানা গেছে। গৌরী লঙ্কেশ হত্যার আগে, আততায়ীদের বেঙ্গালুরুতে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করার জন্য অমোল কালেকে সাহায্য করেছিল রাজেশ। এক বন্ধুর সূত্রে তাদের বাড়ি খুঁজে দিয়েছিল সে।
বিশেষ তদন্তদলের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোপন সংগঠনের কাজে বহুদূর বিস্তৃত ছিল রাজেশ বাঙ্গেরার হাত। হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির প্রাক্তন সদস্য বীরেন্দ্র তাওয়াড়ে, যাকে সিবিআই নরেন্দ্র দাভোলকরকে হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রী বলে অভিযুক্ত করেছে, তাকে শারীরিক আক্রমণের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল রাজেশই। এমনকি, অমোল কালেকে প্রশিক্ষণ শিবিরে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিংও দিয়েছিল এই সরকারি কর্মী।
আরও পড়ুন, উমর খালিদের উপর হামলায় গুলি চলেছিল, দাবি পুলিশের
একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘‘রাজেশ বাঙ্গেরা কয়েক ডজন প্রশিক্ষণ শিবির সংগঠিত করেছে। প্রত্যেক ক্যাম্পে চার থেকে পাঁচজনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। বাঙ্গেরা জানত না, তার কাছ থেকে নেওয়া প্রশিক্ষণ কোথায় ব্যবহার করা হবে, তবে ছবি দেখলে, যারা তার কাছ থেকে ট্রেনিং দিয়েছিল, তাদের সে শনাক্ত করতে পারে। বাঙ্গেরার গ্রেফতারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’
গত মাসে তাকে গ্রেফতারির পর আদালতে তোলা হলে, সরকারি আইনজীবী এস ভি ভডাভাডাগি বলেন, দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের বহু লোককে বাঙ্গেরা আগ্নেয়াস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিয়েছে।