Advertisment

গৌরী লঙ্কেশ মৃত্যুর দু বছর পার: "এখনও ওর কণ্ঠস্বর জেগে আছে"

ওঁদের জীবন এতটাই জড়িয়ে ছিল একে অপরের সঙ্গে, যে তা যমজের থেকেও বেশি। বলছেন গৌরী লঙ্কেশের বোন কবিতা লঙ্কেশ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Gauri Lankesh

কবিতা লঙ্কেশ

গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুকাণ্ডে ১৬ জনের গ্রেফতারির পর তদন্ত কি একরকম শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে?

Advertisment

আমি মনে করি কর্নাটক রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তদল দারুণ কাজ করেছে। গোড়ার মাসগুলোতে আমাদের কোনও আশাই ছিল না। কিন্তু প্রথম গ্রেফতারির পর গোটা বিষয়টা খুব দ্রুত ঘটে গিয়েছিল। এই তদন্ত থেকে আমরা জানতে পেরেছি কালবুর্গী হত্যাকাণ্ডের সূত্রের কথা (পুলিশ বলছে গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকারীদের যে গাড়িতে করে ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর খুন করার জন্য তাঁর বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই গাড়ির চালক গণেশ মিসকিন-ই ২০১৫ সালের ৩৯ অগাস্ট কালবুর্গির উপর গুলি চালিয়েছিল)। এখন আমাদের সরকারি আইনজীবীকে চাপ দিতে হবে। আমি এখনও বলতে পারি না যে আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমরা তো বোনকে ফেরত পাব না। কিন্তু যদি খুনিরা শাস্তি পায়, তাহলে ওরা জানবে যে পার পাওয়া যায় না।

 তদন্তে জানা গিয়েছে যারা হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে অতি দক্ষিণপন্থীরা চক্রান্ত করছে। আপনি কি এতে বিস্মিত?

হিন্দুত্বের জন্য কেউ কাউকে খুন করতে পারে এটা খুবই বিস্ময়ের। প্রথমত, এর আগে আমি কখনও সনাতন সংস্থা বা হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির নামই শুনিনি। এ ঘটনায় যারা যুক্ত তারা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের, খুব একটা শিক্ষিতও নয়। ওদের ভাবানো হয়েছিল যে খুন করে হিন্দুদের বাঁচাচ্ছে ওরা। পরশুরাম ওয়াগমোরে, যে গুলি চালিয়েছিল, সে তো এ কথাও জানত না যে গৌরী লঙ্কেশ সাংবাদিক ছিল। ওকে লুপে ফেলে একটা ভিডিও দেখানো হয়েছিল, যেখানো গৌরী হিন্দুত্বের আদর্শের সমালোচনা করে দলিত-মুসলিম ঐক্য ও তাদের ক্ষমতায়নের কথা বলেছিল। তাতেই ও খুন করার জন্য খেপে উঠেছিল। গৌরী সহজ টার্গেট ছিল একা থাকত, নিরিবিলি জায়গায়। ওরা ৬ মাস ধরে পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু এ ঘটনা ঘটানোর জন্য ওরা প্রচুর টাকাও নিয়েছিল। এ ঘটনার মূল চক্রী যে দুজন, যারা এদের ব্রেনওয়াশ করেছিল, তারা এখনও পলাতক। তারাই টাকা জুগিয়েছিলষ আমি পুলিশকে বলে চলেছি যে আপনাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি।

আরও পড়ুন, ঘরে কী কী বই আছে?

সাম্প্রদায়িকতার হাতে আক্রান্ত হবার ব্যাপারে গৌরী কতদূর অবগত ছিলেন?

ও খুবই সচেতন ছিল। ও আমাদের এটা বলতও, কিন্তু আমরা বলতাম রাজনীতি নিয়ে কথা বলা বন্ধ কর। আমরা জানতাম না ব্যাপারটা বিপজ্জনক ছিল। আমরা ওকে অত বড় বলে ভাবতাম না। ও তো একজন সাংবাদিক আর অ্যাক্টিভিস্ট ছিল। ওকে কেন খুন করা হবে! আর আমরা হলাম লঙ্কেশ (লেখক ও সংবাদপত্রকার পি লঙ্কেশ) পরিবারের লোকজন। বাবা নিজের লেখার জোরে সরকার ফেলে দিয়েছিল। কিন্ত কোনও শত্রুতা বা ঝুঁকি ছিল না। এখন আমার মেয়ে ও বন্ধুরা বলে, সোশাল মিডিয়ায় মুখ না খুলতে। এখন বিজেপি- আরএসএসের বিরোধিতা করা মানেই অ্যান্টি ন্যাশনাল। এখন লোক নির্ভয়ে বিভাজনমূলক বিবৃতি দিয়ে চলেছে। এই (ভোপালের সাংসদ) প্রজ্ঞা ঠাকুরের কথাই ধরুন না, ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা কোথায় গেল?

দু বছরে আপনি কি পাল্টে গিয়েছেন?

হ্যাঁ, সম্পূর্ণ। না হলে প্রজ্ঞা ঠাকুর কে সে কথাই আমি জানতাম না। প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমি খবরের কাগজ বা টিভি খুলতাম না, ওরা তখন শুধু বীভৎস ছবি দেখাত। কিছুদিন পর থেকে লোকজন আমাকে বলার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করে। আমি ব্যক্তি গৌরীকে নিয়ে কথা বলতাম। তারপর আস্তে আস্তে আমিও রাজনৈতিক হয়ে উঠতে শুরু করি। আমি এখনও অ্যাক্টিভিস্ট নই। মাঝে মাঝে ভাবি আমি যদি আদের মতই মূর্খ থাকতাম তাহলে ভাল হত। এ সব বড় হৃদয়বিদারক, খুব বিপর্যস্ত করে দেয়। এই ধর্মীয় গোঁড়ামি, মানুষের মুখ বন্ধ করে দেওয়া। এর আগে আমায় লোকে চিত্রপরিচালক বলে চিনত। এখন তারা আমায় গৌরী লঙ্কেশের বোন বলে ডাকে।

আপনাদের পরিবার কি আগের চেয়ে ভীত?

প্রথম ৬ মাস আমার বাড়ির পাশে কেউ বাইক রাখলেই আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হবার উপক্রম হত।

পিছন ফিরে তাকালে কী মনে হয়, কেন গৌরী খুনিদের কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন?

এর আগে আমার বাবা যখন খাদি শিল্পের কৃষকদের জন্য প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন চিত্রপরিচালক, শিল্পী, থিয়েটার কর্ম, লেখক সবাই মুখ খুলেছিলেন। এখন সবাই নিজের লড়াই লড়ছে। কোনও বড় সংগ্রাম হচ্ছে না।

গৌরী সম্ভবত বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল কারণ ওর সঙ্গে অনেকের যোগাযোগ ছিল, ও দলিত, ক্রিশ্চান এবং মুসলিমদের একত্রিত করেছিল। ও নকশালপন্থীদের মূল স্রোতে আনার চেষ্টা করেছিল, অস্ত্রবিহীন যুদ্ধে তাদের অংশ নেওয়ানোর চেষ্টা করেছিল। ওরা বলে, ওহ গৌরী তো নকশালদের সমর্থন করত... কিন্তু তারা কি জানে যে নকশালপন্থীরা কিসের জন্য লড়াই করছে! ওরা জমির অধিকারে জন্য, সমতার জন্য সংগ্রাম করছে। ওরা কিছুই জানে না।

আরও পড়ুন, মাওবাদ: ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন জঙ্গলমহল’ এবং বম্বে হাইকোর্টের মন্তব্য

আপনাদের একসঙ্গে বেড়ে ওঠার গল্প বলুন

গৌরী ছিল আমাদের পরিবারের প্রথম বিদ্রোহী, আমাকেও সে পথই দেখিয়েছিল ও। ও সম্বন্ধ করে বিয়ের বিরোধী ছিল, তারপর কেউ শুধু ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়র হবে, সে ধারণাও প্রত্যাখ্যান করেছিল। আমরা অনেক পড়তামও। আমার বাবা আমাদের জামাকাপড় কিনে দিতেন না, কিন্তু বই কিনতে চাইলে ব্ল্যাঙ্ক চেক লিখে দিতেন। আমরা প্রতিদিন রাতে ঘুমোতে যাবার আগে পড়তাম, সে পিজি উডহাউস হোক কিংবা সমারসেট মম। আমরা যখন নেহাৎই শিশু ছিলাম তখনও গৌরী ফাইটার ছিল। কিন্তু শান্তিবাহিনীর কাজও ও-ই করত। আমার মায়ের সঙ্গে আমার অনেক পার্থক্য ছিল। গৌরীই একমাত্র আমাদের মিলমিশ করিয়ে দিতে পারত। এখন আমার মেয়ে সেই জায়গা নিয়েছে। আমরা এতটাই এক রকম দেখতে ছিলাম যে লোকে আমাদের গুলিয়ে ফেলত। আমি কোনও অনুষ্ঠানে গেলে আমাকে অ্যাক্টিভিস্ট বলে পরিচয় দেওয়া হত। ওকে জিজ্ঞাসা করা হত পরের ছবি কী। ও মারা যাবার পর অনেক কাগজে আমার ছবি ওর বলে ছাপা হয়েছিল। আমাদের জীবন এতটাই জড়ানো ছিল যে তা যমজের থেকেও বেশি। মারা যাবার দু দিন আগে, রবিবার পর্যন্তও ও এখানে ছিল। ও একা থাকত বলে আমি কিছু খাবারও দিয়ে দিয়েছিলাম। যেদিন ও মারা গেল, সেদিন ওর গাড়িতে সে খাবারটা ছিল। ইংরেজি সাংবাদিকতায় অভ্যস্ত একজনকে কাগজ চালানোর জন্য দিল্লি থেকে বেঙ্গালুরুতে চলে আসাটা কতটা কঠিন ছিল?

ও ইংরেজিতে লিখত, তারপর সেগুলো কন্নড়ে অনুবাদ করা হত। কিন্তু দু বছরের মধ্যে ওর কন্নড় এত ভাল হয়ে গেল যে ও প্রুফরিডারের কাজও করতে পারত। এই কঠিন কাজগুলোর মধ্যে ও দারুন আনন্দ পেত। কারণ ও তৃণমূলস্তরে পৌঁছে যাচ্ছিল। ও আন্দোলন থেকে ফিরে আমাদের মজার মজার গল্প শোনাত। বাবা বুডানগিরি আন্দোলনের সময়ে চিকমাগালুর জেলে কীভাবে লুকিয়ে মদ খেয়েছিল, কিংবা রাতে থানায় থাকতে হবে বলে সকলের জন্য বেডশিট নিয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন, আসামের মিঞা কবিতার ইতিহাস, ভূগোল ও দেশপ্রেম

আজকের আপনাকে দেখলে উনি কী ভাবতেন?

ও টাউন হলের যে বিক্ষোভে যাচ্ছে, সেখানে আমাকেও যেতে বলত, যার সময় আমার হত না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর জন্যেই আমি গ্রেফতার হলাম। ওর মৃত্যুর তিন মাস পর আমাদের টিম সরকারের উপর চাপ সৃ্ষ্টি করার জন্য একটা প্রোগ্রাম করেছিল। হঠাৎ পুলিশ আমাদের ঘিরে ফেলে। বাসে করে থানায় নিয়ে যায়। আমরা চা খাই, গান করি, তারপর ওরা আমাদের ছেড়ে দেয়। ও নিশ্চয়ই খুশি হত এ কথা জেনে যে আমি মূল্যবান কিছু করছি। ও থাকলে আমরা আরও কথা বলতাম। এবার আমি ওকে কথা বলতে দিতাম।

গত দু বছরে কতটা মানিয়ে নিতে পেরেছেন?

এ তো ব্যক্তিগত ক্ষতি। দিনের মধ্যে বহুবার, হঠাৎ হঠাৎ খুব খালি লাগে। কিন্তু একই সঙ্গে এইসব প্রোগ্রামে যে আমি এখন যাচ্ছি, মনে হয় যেন ওর কণ্ঠস্বর সঙ্গে রয়েছে। আপনার মত প্রতি সপ্তাহে অনেকেই আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসেন। আমার মনে হয় ও যেন এখানে আছে, অন্তত আত্মিকভাবে হলেও। ও বিস্মৃত হয়ে যায়নি। এতে যন্ত্রণা কমে না, কিন্তু ফাঁকা লাগার বোধটা একভাবে কমে।

ধর্ম নিয়ে ওঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল?

ও কোরাণ পড়েছিল, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম ও বচন পড়েছিল। ও নাস্তিক ছিল, কিন্তু কোনও ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না। কিন্তু ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া, বৈচিত্র্যকে নষ্ট করার বিরুদ্ধে ছিল। অধিকারের সপক্ষে কথা বললে আরএসএস যদি রেগে যেত তাহলে ও খুশি হত খুব। ২০০৬ সালে কর্নাটকে সিমোগায় এক সাহিত্যসভায় ও আক্রান্ত হয়েছিস। সে নিয়ে ওর খুব গর্ব ছিল। কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে পালিয়ে যাবার মানুষ ছিল না ও।

আপনি কীভাবে ওঁকে মনে রাখতে চান?

ভরপুর জীবনীশক্তির একজন মানুষ হিসাবে। তদন্তকারী দলের সদস্যরা আমাকে বলেছেন, আপনার বোন মহাত্মা ছিলেন, ওঁর মৃত্যুতে হিট লিস্টে থাকা অনেক মানুষ বেঁচে গিয়েছেন। এর পর মনে হয় ওর মৃত্যু বৃথা যায়নি।

যে মতাদর্শের কারণে ওঁকে খুন হতে হল, সে নিয়ে আপনার কী মনে হয়?

এ তো হিন্দু সন্ত্রাসবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। রাজনীতিবিদরা এই ঘৃণাকে আমাদের জীবনে নিয়ে এসেছেন। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বহু ক্রোধ আছে, কিন্তু কিছুটা করুণাও আছে। এরা এত বিপথচালিত। যদিও আমি বিচার চলার সময়ে যাইনি। আমি জানি না আমি ওদের মুখোমুখি হতে পারতাম কিনা।

Read the Full Story in English

gauri lankesh Hindu Janajagruti Samiti
Advertisment