/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/04/bangladesh-logo.jpg)
নুসরত জাহান রফির মৃত্যুতে উত্তাল বাংলাদেশ
মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ এনেছিল সে। সেই 'অপরাধে' ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার ভেতরেই পুড়িয়ে মারা হলো তাকে। এই ঘটনায় গত এক সপ্তাহ ধরে উত্তাল হয়ে উঠেছে গোটা বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮ জনকে।
নুসরত জাহান রফির বয়সও হয়েছিল মাত্র ১৮। চট্টগ্রাম জেলার ফেনি শহরে সোনাগাজি ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার ছাত্রী ছিল সে। তার এবং তার পরিবারের পক্ষ থেকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ করা হয় ২৭ মার্চ। পুলিশকে দেওয়া বয়ানে নুসরত জানায়, ওই দিন তাকে নিজের অফিসঘরে ডেকে পাঠান অধ্যক্ষ, এবং বারবার অনুচিতভাবে স্পর্শ করেন। ঘটনা আর বেশিদূর গড়ানোর আগে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নুসরত।
৬ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাদে চারজন বোরখাধারী দুষ্কৃতীর হাতে আক্রান্ত হয় নুসরত, তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পুুড়ে গেছে, এই অবস্থাতেও হাসপাতালে যাওয়ার পথে ঘটনার বিবৃতি দেয় সে। সেই বিবৃতি, এবং পুলিশের হাতে আসা একটি চিঠি, বর্তমানে এই মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ।
মূল বয়ান
২৭ মার্চ পুলিশকে দেওয়া নুসরতের বয়ান গোপন থাকার কথা ছিল। থাকে নি, কারণ সোনাগাজি মডেল থানার অফিসাররা সেই বয়ানের ভিডিও তুলে স্থানীয় মিডিয়ায় ফাঁস করে দেন। অচিরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় সেই ভিডিও, এবং মৌলবাদীদের নিশানা হয়ে যায় নুসরত, যার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভিডিওতে।
আরও দেখা যাচ্ছে, ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছে নুসরত। তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছেন না ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, যিনি নিজেই রেকর্ড করেন ভিডিওটি। বরং তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, "এমন কিছু" ঘটে নি। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এমন আশ্বাস দিয়ে নুসরতকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন তিনি। ওই ওসিকে বর্তমানে অন্য বিভাগে বদলি করে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ, কিন্তু জেল হাজত থেকেই তাঁর অনুগামীদের প্ররোচিত করতে থাকেন তিনি। নুসরতের সহপাঠিনী এবং অন্যান্যরা বারবার অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে তার উপর।
মাদ্রাসার ছাদে আগুন
মূল অভিযোগ দায়ের করার ১১ দিনের মাথায় ৬ এপ্রিল নুুুুসরত ফাইনাল আলিম পরীক্ষা দিতে তার ভাইয়ের সঙ্গে মাদ্রাসায় যায়। ঢাকা ট্রিবিউন জানাচ্ছে, তার এক সহপাঠিনী তাকে ছাদে নিয়ে যায় এই বলে, যে সেখানে তার এক বন্ধুকে মারধর করা হচ্ছে। এর পরেই বোরখা পরিহিত চার-পাঁচজন নুসরতকে ঘিরে ধরে জোর করতে থাকে যেন সে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ ফিরিয়ে নেয়। তা করতে অস্বীকার করায় এরপর নুসরতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় ওই দুষ্কৃতীরা।
স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা করানো যাবে না বুঝে ৮০ শতাংশ পুুড়ে যাওয়া নুুুুসরতকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। অ্যাম্বুলেন্সে করে স্থানীয় হাসপাতালে যাওয়ার পথে ভাইকে নিজের বয়ান রেকর্ড করে নিতে বলে নুসরত, তার আরও শারীরিক অবনতি হওয়ার আগে। ১০ এপ্রিল হাসপাতালেই তার মৃত্যু হয়।
এখন পর্যন্ত গ্রেফতার
এই মামলায় এখন অবধি গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮ জনকে। পুলিশের বক্তব্য, পরিকল্পনা মাফিক এই মৃৃৃত্যু ঘটিয়েছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, পড়ুয়া, এবং কর্মচারীরা। ঢাকা ট্রিবিউন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন, শাহাদত হোসেন শামিম, নুরুদ্দিন, এবং হাফেজ আব্দুল কাদের ৫ এপ্রিল জেলে সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে দেখা করে তার পরের দিন খুনের ছক কষে। বোরখা পরা দুষ্কৃতীদের মধ্যে একজন ছিল শামিম।
ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল দুই ছাত্রী, যাদের মধ্যে একজনকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। একজন ছাত্রী নুসরতকে ছাদে নিয়ে যায়, অন্যজন শামিমকে কেরোসিন এবং বোরখা জোগান দেয়, বলছে ঢাকা ট্রিবিউন।
ঢাকা ট্রিবিউন আরও জানিয়েছে, আদালতে বিচার চলাকালীন আব্দুর রহিম প্রকাশ শরিফ নামে গ্রেফতার হওয়া এক ছাত্র জানায়, "সমগ্র ঘটনার পরিকল্পনা করা হয় খুনের আগের রাতে, মাদ্রাসা বিল্ডিংয়ের পাশে পশ্চিমের ডরমিটরিতে। শাহাদাত হোসেন শামিম আমাদের কাজ বুঝিয়ে দেয়। ঘটনার দিন নুরুদ্দিনের নেতৃত্বে সাতজনের একটি দল সকাল থেকে গেট পাহারা দেয়, ওদিকে মাদ্রাসার ভেতরে নুসরতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় পাঁচজন, যাদের লিডার ছিল শাহাদাত হোসেন শামিম। ঘটনার পর যে যার মতো এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।"
পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন দেশের শাসকদল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত সোনাগাজির মিউনিসিপ্যালিটি কাউন্সিলর মকসুদ আলম, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দশ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন এই খুনের চক্রান্ত সফল করতে।
নুসরতের চিঠি
তার উপর আক্রমণের আগে ক্লাসের নোট খাতায় লেখা নুসরতের একটি চিঠি উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুই সহপাঠিনীকে উদ্দেশ্য করে ওই চিঠিতে নুসরত লেখে কীভাবে তাকে যৌন নিগ্রহ করেন অধ্যক্ষ, এবং সিরাজ-উদ-দৌলার মুক্তির দাবিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তার সহপাঠিনীদের উপস্থিতি কতটা আঘাত দিয়েছে তাকে। ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন-পাতার চিঠির একটি পাতা পাওয়া যায় নি।
চিঠিতে নুসরত যা লেখে, তার মর্মার্থ হলো, "তমন্না, সাথী, তোমরা আমার বোনের মতো। তোমরা আমার বোনই। সেদিন তমন্না বলে আমি নাকি নাটক করছি। তোমার সামনেও একথা বলে সে। আরও অনেক কথা বলে সে, যে তুমি নিশাতকে বলেছ যে আমরা খারাপ মেয়ে। বোন, কাউকে ভালবাসা কি খারাপ? কীভাবে তোমরা সব জেনেশুনেও সিরাজ-উদ-দৌলার মুক্তির দাবি জানাও? তোমরা জানো না ওই ঘরে কী হয়েছিল? কোথায় আমাকে তিনি স্পর্শ করেছেন এবং কোথায় স্পর্শ করার চেষ্টা করেছেন?"
নুসরত আরও লেখে কীভাবে ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের বিনিময়ে তাকে শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার প্রস্তাব দেন সিরাজ-উদ-দৌলা। "তিনি আমাকে বলেন 'নুসরত, নাটক কোরো না; তুমি ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করতে পারো, কিন্তু তারা তোমাকে কী দিতে পারে? আমি তোমাকে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন বলে দেব।' বদলে আমাকে আমার শরীর দিতে হবে। আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে লড়ব।"
চিঠির শেষে নুসরত লেখে, তার নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার ভাবনা ভুল, এবং যোগ করে যে সে বেঁচে থেকে তাকে যিনি নিগ্রহ করেছেন তাঁর শাস্তি নিশ্চিত করবে। সে আরও লেখে, এই শাস্তির মাধ্যমে সে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চায়, যাতে "তাঁর মতো ঘৃণ্য আরও যারা আছে, তারাও শিক্ষা পাবে"। "তিনি এমন শাস্তি পাবেন যে অন্যরাও তা থেকে শিক্ষা নেবে। আমি তাঁকে কঠোরতম শাস্তি দেব, ইনশাল্লাহ," ছিল বক্তব্যের সারসংক্ষেপ।
প্রতিবাদে মুখর দেশ
১১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ জুড়ে তীব্র প্রতিবাদে সামিল হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুব শাখা, একাধিক এনজিও এবং মানবাধিকার সংগঠন। সারা দেশে চলছে অবস্থান এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন। বৃহস্পতিবার খুলনায় ঘটনার প্রতিবাদে মানব শৃঙ্খল গড়ে তোলে বাংলাদেশ জেনারেল স্টুডেন্টস রাইটস কাউন্সিল। মাদারিপুরে জেলা ন্যাশনাল চিল্ড্রেন্স টাস্ক ফোর্সও মানব শৃঙ্খল গড়ে প্রতিবাদ জানায়। এছাড়াও মাদারিপুরের ডেপুটি কমিশনার মহম্মদ ওয়াহিদুল ইসলামের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতরে চিঠি দেয় তারা।
১৩ এপ্রিল এক প্রতিবাদ সমাবেশে বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, নুসরতের হত্যা ন্যায়বিচারের অভাবের প্রতিফলন। ঢাকা ট্রিবিউন তাঁকে উদ্ধৃত করে লেখে, "দোষীরা জানত যে যতক্ষণ তারা শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অপরাধের কোনও সাজা হবে না।" সেলিম সরাসরি এই ঘটনার দায় চাপান শাসকদল আওয়ামী লীগের ওপর এই বলে, যে তারা তাদের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলিকে অপরাধমূলক কাজের অনুমতি দিয়ে থাকে।
আশ্বাস
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছেন, আইন দোষীদের ছাড়বে না। কিন্তু তিনি যাই বলুন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংগঠন জানাচ্ছে, বাংলাদেশে যৌন অপরাধের শাস্তির হার অত্যন্ত কম। নুসরতের হত্যার আন্দাজ চার বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ব্যাপক যৌন হেনস্থার শিকার হন অন্তত ২০ জন মহিলা। সেই মামলার প্রায় কোনও অগ্রগতি হয় নি, বলছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এতেই শেষ নয়। ২০১৮ সালের প্রথম ছ'মাসে কমপক্ষে ৫৯২ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ বলে একটি সংগঠন। এছাড়া ২,০৬৩ জনের বেশি মহিলা ও শিশু বিভিন্ন ধরনের হিংসার শিকার হন, যে তালিকায় রয়েছে ধর্ষণ, ইভ টিজিং, পণের জন্য শারীরিক হেনস্থা, ইত্যাদি। পরিষদের রিপোর্ট উদ্ধৃত করেছে ঢাকা ট্রিবিউন।
যেহেতু কর্ম বা শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা সংক্রান্ত কোনও নির্দিষ্ট আইন নেই, সেহেতু বাংলাদেশে যৌন হেনস্থার ঘটনা বড় একটা নথিভুক্ত হয় না, বলছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। ২০০৯ সালে হাইকোর্ট প্রস্তাব দেয়, যৌন হেনস্থার ঘটনার শুনানির জন্য প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কমিটি গঠন করা হোক। কিন্তু কোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে তৈরি খসড়া বিল চূড়ান্ত করতে অসমর্থ হয়েছে ২০০৯-এর পরবর্তী সমস্ত সরকার।