Advertisment

হিন্দিকে সবচেয়ে বেশি বেগ ফের দেবে তামিলনাড়ু

কিছু কিছু এলাকায় সিবিএসই স্কুলের মাধ্যমে সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষাকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা চললেও তামিল নাড়ুতে হিন্দির উপস্থিতি অতি নগণ্য।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Hindi National Language, Tamil Identity

তামিলনাড়ুর দুই নেতা কামাল হাসান ও স্ট্যালিন এর মধ্যেই মুখ খুলেছেন

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শনিবার বলেছেন, হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা। তিনি বলেছেন সারা দেশের এটিই সাধারণ ভাষা। এ নিয়ে দক্ষিণের রাজ্যগুলি এবং পশ্চিম বঙ্গ থেকে আপত্তি উঠেছে বটে, তবে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসা এখনও সময়ের অপেক্ষায়। এ ধাক্কা আসবে তামিলনাড়ু থেকে।

Advertisment

তামিলনাড়ুর সামাজিক রাজনৈতিক জীবনযাত্রার জোড়া স্তম্ভ রাজনৈতিক নেতা এবং চলচ্চিত্র অভিনেতারা। তাঁরা ইতিমধ্যেই এ নিয়ে তীব্র আপত্তি তুলতে শুরু করেছেন। অভিনেতা-রাজনীতিবিদ কামাল হাসান এঁদের মধ্যে অগ্রণী। তিনি বলেছেন, প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হওয়ার সময়ে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের যে প্রতিশ্রুতি, তাকে কোনও শাহ, সুলতান বা সম্রাট টলাতে পারবে না। ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিন এই পদক্ষেপকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছেন এবং তিনি ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্য জোড়া আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন।

আরও পড়ুন, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শত্রু

সরাসরি ভাষার সঙ্গে যুক্ত না হলেও সোমবার অভিনেতা সুরাইয়ার মহাত্মা গান্ধীর হত্যা নিয়ে দ্রাবিড় নেতা পেরিয়ারকে উদ্ধৃত করার ঘটনা রাজনৈতিক মহলে সাড়া ফেলেছে। পেরিয়ারকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, গান্ধী হত্যায় গডসে কেবল ব্যবহৃত বন্দুকমাত্র।

অমিত শাহের আকস্মিক মন্তব্যের সুযোগ নিতে দেরি করেননি স্ট্যালিন এবং কামাল হাসান। কারণ দ্রাবিড় রাজনীতির ডিএনএ হল হিন্দি বিরোধিতা। দ্রাবিড় সংস্কৃতির অন্যতম অনুঘটক হল হিন্দি বা অন্য যে কোনও ধরনের উত্তর ভারতীয় ভাষার বিরোধিতা।

বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কিছুদিন অন্তর দলের নেতারা হিন্দির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। ২০১৪ সালে, ইউজিসি তামিলনাড়ির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে একটি সার্কুলার পাঠিয়েছিল বলে খবর। সে সার্কুলারে হিন্দিকে প্রধান ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করানোর কথা বলা হয়েছিল। সে বছরই সিবিএসই স্কুলের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেছিলেন সরকার চায় হিন্দিকে দক্ষিণ ও উত্তর পূর্ব ভারতের সরকারি দফতরের রুটিন ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে।

২০১৬ সালে ফের সংস্কৃত ভাষার বিরোধিতা সামনে আসে। ৯২ বছরের করুণানিধি উত্তর ভারতীয় ভাষার বিরুদ্ধে সুর চড়ান। তিনি বলেছিলেন, "আবার হিন্দি বিরোধী আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি করবেন না। যদি ওরা তেমন পরিকল্পনা করে তাহলে সংস্কৃতের প্রাধান্য বিরোধিতায় প্রতিটি তামিল শামিল হবে। আসুন আমরা শপথ নিই, তামিলনাড়ুতে সংস্কৃতের কোনও জায়গা নেই।"

সাংস্কৃতিক ভাবে স্বায়ত্তশাসিত তামিল নাড়ুর ক্ষেত্রে হিন্দি ও সংস্কৃত কেবল ভাষামাত্র নয়, এরা উত্তর ভারতীয় আধিপত্যের মেটাফর। দলমত নির্বিশেষ এর বিরুদ্ধে গণ সমাবেশ ঘটে যায় এখানে, এবং যাঁরা সময়ে সময়ে বিজেপিকে সমর্থন দেন, তাঁরাও এতে শামিল হন। দক্ষিণ ভারতের অন্য কোনও রাজ্যের জনগণের সামাজিক রাজনৈতিক স্বরাজ্যের বোধ তামিলনাড়ুর মত নয়। এর ফলেই দক্ষিণের এ রাজ্য অনন্য হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন, হিন্দি নিয়ে অমিত শাহের মন্তব্যের সমালোচনায় বিরোধী শিবির

এ রাজ্যের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে এরকম হওয়া আশ্চর্যেক নয়। হিন্দি বিরোধী ভাবাবেগ এখানে কাজ করেছে স্বাধীনতা পূর্ব সময় থেকেই। বিংশ শতাব্দীর ৩-এর দশকে যথন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী সি রাজাগোপালাচারী হিন্দি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন তখনও প্রতিবাদ উঠেছিল। ৪-এর দশকে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল যখন কংগ্রেস সরকার ফের এই একই চেষ্টা করে। ৬-এর দশকে কেন্দ্রীয় সরকার যখন হিন্দিকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করেছিল, তখনও প্রতিবাদে মুখর হয় তামিলনাড়ু। এই আন্দোলনের ধাক্কাতেই তামিল নাড়ুর রাজনীতি থেকে কংগ্রেস ও জাতীয়তার ভাবাবেগ দুইই ধুয়ে মুছে গিয়েছিল এবং প্রাদেশিক গৌরব ও দ্রাবিড় আন্দোলনের হাত শক্ত করেছিল।

কিছু কিছু এলাকায় সিবিএসই স্কুলের মাধ্যমে সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষাকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা চললেও তামিল নাড়ুতে হিন্দির উপস্থিতি অতি নগণ্য। ১৯৬৫ সালের হিন্দি বিরোধী আন্দোলনের পরেও জাতীয় সরকার বারবার চেষ্টা করেছে এ রাজ্যের উপর হিন্দি চাপাতে। ১৯৮৬ সালে নবোদয় বিদ্যালয়ের মাধ্যমে হিন্দি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে এই সন্দেহের বশে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে লড়েছিল ডিএমকে। ২০১৪ সালে সরকারি আধিকারিকদের সোশাল মিডিয়ায় হিন্দি ভাষা ব্যবহার করার কেন্দ্রীয় নির্দেশিকা এবং তামিল নাড়ুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দিকে মুখ্য ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ইউজিসি নির্দেশিকার কড়া বিরোধিতা করেন জয়ললিতা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, হিন্দি চাপানোর মূল দায়ভার যাধের উপর বর্তায়, সেই কংগ্রেস কিন্তু ২০১৪ সালে জয়ললিতাকে সমর্থন দেয়।

বারবার ধাক্কা খাওয়া সত্ত্বেও, বিজেপি এবং তার নেতারা বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত দেখতে এবং তামিল নাড়ুর প্রতিরোধ যে কেবলমাত্র প্রাদেশিক গৌরবের বোধ থেকেই, সে কথা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাস্তবত, এ বিষয়টি বহুভাবে সামনে আসে, কিন্তু সম্ভবত তা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় হিন্দি বিরোধী আন্দোলনে।

শ্রীলঙ্কার তামিল ইস্যু, মুল্লাপ্পেরিয়ার ও কাবেরী, জালিকাট্টু, জিএসটি বা নিট- যখনই তামিলদের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে- তখনই রাজ্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবত, বিজেপির একদা সঙ্গী জয়ললিতা প্রাদেশিক স্বরাজের বিষয়টিতে এখনকার রাজনীতিবিদদের মধ্যে সবচেয়ে সোচ্চার। রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর যে কোনও রকম কেন্দ্রীয় সরকারি সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের অপেক্ষা করিয়েছেন এবং দিল্লির উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার নীতিকে উপেক্ষা করেছেন।

স্ট্যালিন ও কামাল হাসানরাও যে এই পথেই যাবেন, তাতে সন্দেহ নেই।

tamil nadu
Advertisment