প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন তাঁর বই Choices — Inside the Making of India’s Foreign Policy-তে, ২৬-১১ হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত কেন সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, সে নিয়ে আলোচনা করেছেন।
প্রাথমিকভাবে, পাকিস্তানের উপর ভারতীয় সেনা হামলার ঘটনা, ২৬-১১র হামলা থেকে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি সরিয়ে দিত। তখন গোটা ঘটনাকে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘর্ষ সম্ভাবনা হিসেবে দেখা হত এবং সারা পাকিস্তান নিজেদের দেশের সেনাবাহিনীকে সমর্থন করতে শুরু করত, যে সেনাবাহিনীর ছবি তাদের নিজেদের দেশেই বেনজির ভুট্টোর হত্যার ঘটনার পর থেকে অত্যন্ত মলিন হয়ে পড়েছিল।
আরও পড়ুন, কুলভূষণের কনস্যুলার অ্যাকসেস চাইবে ভারত
তখন নিজেদের আভ্যন্তরীণ স্বার্থেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চাইছিল পাকিস্তান। মেননের মতে ভারত পাকিস্তানের ফাঁদে পা না-দিয়ে ভারত সারা পৃথিবীর দৃষ্টি টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিল পাকিস্তানের জঙ্গি পরিকাঠামোর দিকে। ২৬ নভেম্বরের হামলার আগে পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র উদ্বেগের বিষয় ছিল ওসামা বিন লাদেন এবং পাকিস্তানের তালিবান গোষ্ঠীগুলি।
কিন্তু একই সঙ্গে মেনন এও বলেছেন, পাকিস্তানের মাটি থেকে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে যদি ফের কোনও হামলা ঘটত, তাহলে কোনও সরকারের পক্ষেই অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ত। তার মূল কারণ ২৬-১১ ষড়যন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না-নেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের একগুঁয়েমি।
হামলা করে লাভ নেই
গত সপ্তাহে পুলওয়ামার হামলা ভারতীয় জনমানসে যে প্রভাব ফেলেছে, তা মুম্বই হামলার সমতুল্য। এবং মেননের ১০ বছর আগের সতর্কবার্তার পর এখন জাতীয় পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে, বিজেপি এখন এমন একজনের নেতৃত্বে ক্ষমতায় রয়েছে যিনি শক্তিশালী ইমেজের উপর ভর করে থাকেন, ভোট কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই- সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আভ্যন্তরীণ স্তরেই নানাবিধ চাপ রয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানের অসামরিক সরকারকে নিয়ে ভারতের এখন আর চাপ নেই- কারণ প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তাঁর মন্ত্রীরা বারবার বলেছেন, সরকার সেনাবাহিনীর সঙ্গেই রয়েছে।
তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও ভারতের শীর্ষ সিদ্ধান্তপ্রণেতারা সামরিক ব্যবস্থাগ্রহণের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী কিনা সে কথা স্পষ্ট নয়। এবার যদি ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের এ থেকে ফায়দা তুলতে হয়, তাহলে ২০১৬০র সেপ্টেম্বরে উরি হামলার পর ভারত যে ভাবে প্রত্যাঘাত করেছিল তার থেকে বেশি কিছু করতে হবে।
নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে যে সার্জিকাল স্ট্রাইকের কথা বহু আলোচিত, সে ঘটনা মোদি সরকারকে সমর্থকদের মধ্যে ব্রাউনি পয়েন্ট জোগালেও, তাতে পাক সেনার চরিত্র বদল হয়নি। কোনও সামরিক অপারেশনের সাফল্য বা ব্য়র্থতা মাপার নিরিখ কিন্তু সেটাই। বদলা কোনও রণকৌশলগত উদ্দেশ্য হতে পারে না। ভারত কি ভাওয়ালপুরে জৈশের সদর দফতরে বা মুরিদকে এলাকায় লশকর এ তৈবার সদর দফতরে আকাশপথে মার্কিনি কায়দায় হামলা চালাতে পারবে? তালিবান নেতাদের উপর আমেরিকা যেরকম ড্রোন হামলা চালিয়েছিল, তেমন হামলা যদি ভারত করতেও পারে, তাতে পাকিস্তানের জঙ্গি পরিকাঠামো শেষ হবে না। বরং তাতে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলির উপর পাকিস্তানের সমর্থন বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এবং তার চেয়েও খারাপ সম্ভাবনা, তেমন হামলা হলে বহু অসামরিক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
বলপ্রয়োগ কতদূর কার্যকরী?
গত ১৮ বছর ধরে ভারতের তরফ থেকে বলপ্রয়োগের প্রায় সমস্ত রকম চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে পাকিস্তানের তরফ থেকে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যদি তেমন কোনও বদল ঘটেও থাকে, তা নেহাৎই ক্ষণিকের।
২০০১-০২ সালে সংসদে জৈশ হামলার পর পশ্চিম সীমান্তে আধ মিলিয়ন সৈন্য জড়ো করেছিল ভারত, যা ১৯৭১ সালের পর থেকে পরিমাণে সবচেয়ে বেশি। সেসময়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উপর বিমান হামলার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বাজপেয়ী সরকারকে নিরস্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে তারা পারভেজ মুশরফের ১২ জানুয়ারি, ২০০২-এর দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করে, যেখানে মুশারফ ভারতে সংসদ হামলাকে ভীরুতার কাজ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পাকিস্তানে জঙ্গি পরিকাঠামো ধ্বংস করবেন। ২০০২ সালে ফের একবার ভারতের তরফ থেকে আক্রমণের পরিস্থিতি তৈরি হয়। কালুচকের সেনা শিবিরে ফিদায়েঁ হামলায় নিহত হন ৩৪ জন, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন সেনাবাহিনীর পরিবারের সদস্য। ফের একবার আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিশ্রুতি পেয়ে হামলা থেকে বিরত থাকে ভারত।
আরও পড়ুন, মোস্ট ফেভারড নেশন তকমা উঠে গেছে বলে জানি না, বলল পাকিস্তান
২০১৭ সালের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে ২০০২ সালের জুলাই মাসের শেষে কুপওয়ারা অঞ্চলের কেল এলাকায় নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে পাকিস্তানি বাঙ্কারে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত, কার্গিল যুদ্ধের পর সেটাই ছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রথম এ ধরনের হামলা।
সে সময়েও পাকিস্তানের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল, যে কাজ এবার করা হয়েছে। সিন্ধু জলচুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কথাও ভাবা হয়েছিল সে সময়ে, কিন্তু কার্যত তা ভারতের পক্ষেই হানিকর এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের বিরুদ্ধে যেতে পারে বলে সে কাজ থেকে শেষ পর্যন্ত বিরত থাকা হয়।
বিবাদহীনতার কৌশল
এসব বলপ্রয়োগের কূটনীতি যেমন ছিল, তার সঙ্গেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টাও ছিল, আড়ালে হলেও। এক বছর পর দু দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুরোদস্তুর ফিরে আসে। ২০০৩ সালের মে মাসে ভারত মেননকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দিল্লিতে এসে পৌঁছন আজিজ আহমেদ খান। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাজপেয়ী-মুশারফ সম্মেলন এবং সেখান থেকে যৌথ সিদ্ধান্তকে সংসদ হামলার পর ভারতের কড়া অবস্থানের ফলাফল হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে।
তার পর থেকে বিবাদহীনতাকেই ভারতের মূল অস্ত্র হিসেবে দেখে আসা হয়েছে।
২০০৬ সালের জুলাই মাসে মুম্বইয়ে ধারাবাহিক ট্রেন বিস্ফোরণে ২০৯ জন মারা যান। এর পিছনে ছিল লশকর-এ তৈবা। ভারতের বক্তব্য ছিল, এ ঘটনা দু দেশের মধ্যে আলোচনা সাময়িক ভাবে ব্যাহত করবে। ভারতের আধিকারিকরা অফ দ্য রেকর্ড বলেছিলেন, চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া এবং তারপর ফের আলোচনার টেবিলে ফিরে যাওয়া অর্থহীন। তার চেয়ে সমস্ত দিক খোলা রাখা এবং পাকিস্তানকে দুশ্চিন্তার মধ্যে রাখাই বাল। ইসলামাবাদ ভাবছিল, ভারতকে আলোচনার টেবিলে আনাটাই অনেক। নয়া দিল্লি ভাবছিল পাকিস্তানকে সংশয়ের মধ্যে রাখাই তাদের সবচেয়ে বড় শাস্তি। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে, হাভানায় জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে গিয়ে মুশারফ-মনমোহন সিংয়ের মধ্যে কথাবার্তা ফের দুপক্ষের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনে।
২৬-১১ মুম্বই হামলার পর ভারত ফের আলোচনা বন্ধ করে। তারপর থেকে দু পক্ষের মধ্যে আলোচনা শুরুর চেষ্টা ব্যর্থই হয়েছে। ভারতের তরফ থেকে বলা হয়েছে, সীমান্ত সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছুই আলোচ্য নয়, পাকিস্তান দাবি করেছে কাশ্মীর নিয়েও আলোচনা করতে হবে। পাকিস্তানকে একঘরে করার ব্যাপারে ভারত অবশ্য কিছুটা সাফল্য পেয়েছে, রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার পরিষদে লশকর এ তৈবাকে জঙ্গি সংগঠন এবং হাফিজ সঈদকে সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বন্ধ করেনি সারা বিশ্ব, যা আফগানিস্তানের সঙ্গে পশ্চিমের যুদ্ধের সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকৃত।
উরি হামলার পর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বলিষ্ঠ প্রত্যুত্তর বলে দেখানো হলেও, তাতে কিছু উপকার হয়নি। এখন কাশ্মীর হামলার পর অনেক রকমের সম্ভাবনা এলেও সব কিছুরই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পাকিস্তানে নিযুক্ত প্রাকতন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শরৎ সাবরওয়াল যেমন বলেছেন, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের তকমা প্রত্যাহার কার্যত কেবল প্রতীকী মাত্র। পাকিস্তানের বাণিজ্যে এর প্রায় কোনও প্রভাবই পড়বে না, কারণ ভারতে মোট রফতানিকৃত পণ্যের মাত্র ২ শতাংশ রফতানি করে পাকিস্তান।
Read the Full Story in English