পয়লা অগাস্টের সন্ধেবেলা হাওড়াগামী বাসে জোর চর্চা অফিস ফেরত যাত্রীদের মধ্যে। বিষয় একটাই, ব্যাঙ্ক প্রতারণা। মাস পয়লায় টাকা তুলব কীভাবে? একজন তো বলেই ফেললেন, "ওসব স্কিমার-টিমার যা শুনছি, চেকে টাকা তোলাই ভাল।" আরেকজন বুকে একরাশ আশঙ্কা চেপে বলে ফেললেন, "ভাবছি সব কার্ডগুলো ব্লক করে দিই।"
আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। গত ক’দিনে স্কিমিং ডিভাইস নামক বস্তুর দৌলতে কলকাতার গ্রাহকদের লাখ লাখ টাকা এটিএম থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকরা। প্রতারিতদের মধ্যে কানাড়া ব্যাঙ্ক এবং পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের বহু কর্মীও রয়েছেন। ঘটনায় ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে লালবাজার।
আরও পড়ুন: ব্যাঙ্ক প্রতারণা তদন্তে কলকাতা পুলিসের বিশেষ দল
ব্যাঙ্ককর্মী পরিচয় দিয়ে ফোন করে এটিএমের পিন নম্বর জেনে টাকা হাতানোর কায়দা এখন পুরোনো। এবার এটিএমে স্কিমার (skimmer) লাগিয়ে প্রযুক্তির বলে আরও বলিয়ান হয়ে উঠেছে প্রতারকরা। এরপর কী? আর কী কী উপায়ে আপনার রোজগারের টাকায় থাবা বসাতে পারে প্রতারকরা? টাকা হাতাতে আর কীভাবে ফাঁদ পাততে পারে? কতটা অসুরক্ষিত হতে পারে আপনার ক্রেডিট কার্ড? জানালেন সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত।
১. রেস্তোরাঁয় খাওয়ার পর বিল দেওয়ার সময় আমরা অনেকেই কার্ডটা দিয়ে দিই। বিলিং প্রক্রিয়ার পর কার্ডটা আমাদের ফেরত দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এ সময় আমাদের কার্ডের সব তথ্য ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কার্ডটা নিয়ে গিয়ে কেউ কী করছে, তা জানতে পারব না আমরা। কে বলতে পারে, কার্ডের ছবি তুলে নেওয়া হল না? অনেকসময় ওয়েটার পকেটে করে বিলিংয়ের জন্য কার্ড নিয়ে যান। সেক্ষেত্রে কে বলতে পারে যে ওঁর পকেটে কোনও স্কিমার নেই? POS মেশিন বা কার্ড সোয়াইপ করার মেশিনটি এখন পোর্টেবল। ওটা নিজের কাছে আনিয়ে বিল মেটান। শুধু রেস্তোরাঁই নয়, পেট্রোল পাম্পেও নিজের সামনে কার্ড দিয়ে বিলিং করুন। মোদ্দা, কার্ড হাতছাড়া করবেন না।
২. অনলাইনে শপিং করার সময় ক্রেডিট কার্ড অসুরক্ষিত হওয়ার একটা বড় সুযোগ থাকে। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বিকিকিনির সময় এক্সপ্রেস চেকআউট অপশন দেখায়। ওই অপশনে ক্লিক করলে ঝুঁকি থাকবে। আপনার কার্ডের সব তথ্য সংশ্লিষ্ট সাইটে থেকে যাবে। ফলে ওই সাইটটি যদি কোনওভাবে হ্যাক হয়, আপনার কার্ডও হ্যাক হবে।
৩. সাইবার ক্যাফেতে বসে কোনওভাবেই আর্থিক লেনদেন করবেন না। সব সাইবার ক্যাফেতেই কি লগার নামের একটি সফটওয়ার লাগানো থাকে। কি-বোর্ডে যা আপনি প্রেস করবেন, সব তথ্য ওই সফটওয়ারে চলে যাবে। সাইবার ক্যাফেতে আর্থিক লেনদেন করলে অবধারিত ভাবেই কার্ডের তথ্য ফাঁস হবে। এমন কী, সাইবার ক্যাফেতে ই-মেল লগ ইন করাও ঠিক নয়।
৪. মোবাইলে ক্রেডিড কার্ডে লেনদেন করলেও আপনার কার্ড অসুরক্ষিত হতে পারে। সেলফোনে অনলাইন ব্যাঙ্কিংও ঝুঁকিপূর্ণ। মোবাইলে অ্যান্টি ভাইরাস না থাকলে কার্ডের তথ্য ফাঁস হতে বেশি সময় লাগবে না। তাছাড়া যে মোবাইল ফোনে আর্থিক লেনদেন করেছেন, সেই ফোনটি বিক্রি করলে কিংবা কোনও কারণে চুরি হলে সর্বনাশ, সব ডেটা ফাঁস হয়ে যাবে। মোবাইল নেটওয়ার্ক যেন কখনই পাবলিক নেটওয়ার্ক না হয়। ল্যাপটপের মত মোবাইলেও অ্যান্টি ভাইরাস থাকা আবশ্যক।
কীভাবে এটিএমে লাগানো হয় স্কিমিং ডিভাইস, ভাইরাল এই ভিডিও। pic.twitter.com/tSpA6zPYaU
— IE Bangla (@ieBangla) August 3, 2018
এটিএম থেকে টাকা তোলার সময় কীভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখবেন গ্রাহকরা? উপায় বাতলালেন সন্দীপ সেনগুপ্ত।
১. রক্ষীবিহীন এটিএম থেকে টাকা তুলবেন না।
২. এটিএমের কি-প্যাডে যদি দেখেন অাঠার মতো কিছু লাগানো আছে, টাকা তুলবেন না। প্রয়োজনে ব্যাঙ্ককে জানান।
৩. এটিএমে পিন কোনও কারণে না নিলে, সাবধান হয়ে যান। পিন না নিলে, বা সমস্যা হলে বুঝবেন গড়বড় আছে।
৪. এটিএমে টাকা তোলার সময় কি-প্রেস করার সময় হাত দিয়ে ঢেকে রাখবেন যাতে তা ক্যামেরায় ধরা না পড়ে।
৫. কোনওভাবেই কাউকেই আপনার কার্ড দেবেন না। কার্ড সংক্রান্ত কোনওরকম তথ্যও কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না।
অনেকসময়ই দেখা যায়, ফোনে এমন কিছু মেসেজ আসে, যেখানে একটি নম্বর উল্লেখ করে বলা হয়, ওই নম্বর থেকে ফোন এলে তা রিসিভ করলে, এটিএম কার্ড হ্যাক হতে পারে। এমন কায়দায় কি আদৌ প্রতারকরা টাকা হাতাতে পারেন? জবাবে সন্দীপবাবু বললেন, "এসব ভুয়ো, ভয় দেখানোর জন্য এসব করে। এভাবে কেউ টাকা হাতাতে পারে না।" এটিএমে স্কিমিং ডিভাইস লাগাতে কতক্ষণ সময় লাগে? সন্দীপবাবুর কথায়, "এটিএমে স্কিমার লাগাতে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে।"
এটিএমে স্কিমিং ডিভাইস বসানো আছে কিনা গ্রাহক কী করে বুঝবেন? জবাবে এসবিআই স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন বেঙ্গল সার্কেলের জেনারেল সেক্রেটারি সিদ্ধার্থ খাঁ বলেন, "কার্ড সোয়াইপ করার সময় সবুজ আলো জ্বললে বুঝবেন কোনও স্কিমিং নেই, সবুজ আলো না জ্বললে বুঝবেন সমস্যা রয়েছে।"
আরও পড়ুন: পুলিশের নজরে স্কিমিং ডিভাইস বিক্রির ওয়েবসাইট
এটিএমে স্কিমার ডিভাইস লাগানো হল, অথচ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ঘুণাক্ষরেও টের পেল না! আগামী দিনে এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে ব্যাঙ্কগুলোর কী করণীয়? জবাবে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন স্পেশাল অ্যাসিট্যান্ট অরুণ নন্দী জানালেন, "নিরাপত্তার ফাঁকফোকর তো রয়েইছে। ব্যাঙ্কগুলোকেই এজন্য পদক্ষেপ করতে হবে। প্রয়োজনে এটিএমগুলোতে মনিটারিং করা উচিৎ। সিসিটিভি মনিটারিং করাও দরকার। ব্যাঙ্ক এটিএম বসাতে বিভিন্ন এজেন্সির সাহায্য নেয়। সেই এজেন্সি কতটা বিশ্বস্তভাবে কাজ করছে, তা মনিটারিং করা প্রয়োজন।"
ব্যাঙ্ক প্রতারণা প্রসঙ্গে অরুণবাবু আরও বললেন, "যখন নতুন গ্রাহককে এটিএম কার্ড দেওয়া হয়, সেসময় তাঁদের ভালভাবে গাইড করা উচিত কীভাবে এটিএম কার্ড ব্যবহার করতে হয়। হামেশাই দেখা যায়, এটিএম কাউন্টারে গিয়ে অনেকেই জানেন না কীভাবে টাকা তুলতে হয়। ফলে অন্যের সাহায্য নেন। এতে কার্ডের তথ্য ফাঁস হওয়ার সুযোগ থাকে।"
এটিএম সুরক্ষা প্রসঙ্গে অরুনবাবু বললেন, "আগে এটিএম কাউন্টারে গেলে কার্ড পাঞ্চ করে দরজা খুলে ঢুকতে হত, তারপর টাকা তোলা যেত। এখন তো এই পদ্ধতি নেই বললেই চলে। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এটিএমের দরজা খোলা থাকে।"
সদ্য এটিএম প্রতারণার শিকার রেডিও জকি নীলাঞ্জনা এ নিয়ে বললেন, "কোনও ব্যাঙ্কই এখন নিরাপদ নয়, বাবা-কাকাদের সময় কখনও দেখিনি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উধাও হয়ে যায়। আজ ব্যাঙ্কের নিরাপত্তা কোথায়?"