পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যতই বলুন তিনি জৈশ-এ-মহম্মদের বিরুদ্ধে "কোনো প্রামাণ্য তথ্য" পেলেই পদক্ষেপ নেবেন, তাঁর মুখের কথায় বিশেষ ভরসা করবেন না কেউই। অন্তত জৈশ-এ-মহম্মদের ক্ষেত্রে তো ভরসা করবেনই না, কারণ এই জঙ্গি সংগঠন সম্পর্কে "প্রামাণ্য তথ্য" দীর্ঘদিন ধরেই চেপে বসে আছে পাকিস্তান, এবং জৈশ নেতা মৌলানা মাসুদ আজহারের ক্ষেত্রে সাহায্য চেয়ে একাধিক সরকারি আবেদনে কোনো সাড়া দেয় নি।
বস্তুত, আজহারের নাম দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে উঠে এসেছে - ২০০১ সালের দিল্লিতে সংসদ ভবনে হামলা এবং ২০১৬ সালের পাঠানকোট হামলা। আজহারের বিরুদ্ধে দুটি রেড কর্নার নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল, প্রথমটা সংসদ ভবন কাণ্ডে ২০০৪ সালে, এবং পাঠানকোট বিমান ঘাঁটি হামলায় তার ভূমিকার জন্য ২০১৬ সালে।
সংসদ ভবনের ওপর আক্রমণের পর পাঁচজনের নাম করে দিল্লি পুলিশ। এদের মধ্যে দুজন ছিল আফজল গুরু এবং শৌকত হুসেন গুরু, দুজনেই জৈশের সদস্য। আফজল গুরুকে ২০১৩ সালে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দেওয়া হয়, শৌকতের সাজা কমানো হয়, কিন্তু আজহারের ক্ষেত্রে মামলা বিচার পর্যন্ত গড়ায় নি, কারণ বর্তমানে পাকিস্তানের বাসিন্দা সে। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের আইসি-৮১৪ উড়ান হাইজ্যাক হয় আফগানিস্তানের কান্দাহার বিমানবন্দরে। হাইজ্যাকারদের দাবি ছিল, ভারতীয় কারাগার থেকে মুক্তি দিতে হবে মাসুদ আজহারকে। প্রায় ১৭৫ জন যাত্রীর প্রাণের বিনিময়ে মুক্তি পায় আজহার।
আরও পড়ুন: পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের কথায় অবাক নয় দিল্লি
সংসদ ভবন আক্রমণে আরেক প্রধান অভিযুক্ত গাজী বাবা ২০০৩ সালে শ্রীনগরে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সঙ্গে এক এনকাউন্টারে নিহত হয়। এদিকে পাঠানকোট বিমান ঘাঁটি হামলার তদন্তে নেমে আজহারের নাম করে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। ঘটনায় জৈশের ভূমিকা প্রমাণিত হওয়ার পর, একজন অতিরিক্ত আইজিপি, একজন ডিআইজি, দুজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং একজন ইন্সপেক্টর নিয়ে গঠিত একটি যৌথ তদন্তকারী দল (জেআইটি) ২০১৬ সালে তদন্তে সাহায্য করতে ভারতে পাঠায় পাকিস্তান।
আদালতে জমা দেওয়া তাদের চার্জশিটে এনআইএ জানায়, "এনআইএ-র সিআইও তাদের (পাকিস্তানি দলকে) লিখিতভাবে অনুরোধ করেন যেন প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য, যেমন পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে নিহত সন্ত্রাসবাদীদের পরিবারের থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ-র নমুনা, জৈশ-এ-মহম্মদ এবং আল রহমত ট্রাস্টের বিশদ বিবরণ, এবং মৌলানা মাসুদ আজহার ও অন্যান্য অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ, আমাদের দেওয়া হয়। তারা এই সব বিষয় নিয়ে জানাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়, এবং এও বলে যে ভারতের তরফেও তদন্তকারী দল পাল্টা পাকিস্তান সফরে যাবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উত্তর আসে নি।"
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তদন্তে সাহায্য চেয়ে একটি এলআর বা 'লেটার রোগেটরি' (আদালতের তরফে কোনো বিদেশি আদালতকে দেওয়া চিঠি) এবং তার পরবর্তীতে আরও একটি এলআর পাঠায় এনআইএ, কিন্তু এখন অবধি সাড়া মেলে নি। আজহার ছাড়াও এনআইএ চার্জশিটে নাম ছিল তার ছোট ভাই মুফতি আব্দুল রউফ আসগরের, এবং দুই জৈশ জঙ্গি শাহিদ লতিফ এবং কাশিফ জানের। তারও ওপরে নাম ছিল বিমান ঘাঁটিতে নিহত চার জঙ্গির, যারা সকলেই ছিল পাকিস্তানি নাগরিক। মঙ্গলবার ফের একবার পাকিস্তানের তরফে পুলওয়ামা হামলার তদন্তে সাহায্য করার প্রস্তাব দেন ইমরান খান।
পাঠানকোটের চার্জশিটে এনআইএ বলে, আজহারের নেতৃত্বাধীন জৈশ অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, এবং জাতিসংঘে (ইউএন) সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। চার্জশিটে লেখা হয়, "ইউএন ১২৬৭ কমিটি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জৈশকে সামরিক সংগঠন আখ্যা দেয়, এবং ২০০১ সালে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা করে, এটি একটি বিদেশি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন।" জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাছে আজহারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে চলেছে ভারত, কিন্তু চিন এই প্রয়াস ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যর্থ করে এসেছে।
পাকিস্তান ও জাতিসংঘকে দেওয়া আজহার সংক্রান্ত তথ্যপঞ্জিতে আজহারকে "পাকিস্তানে বসবাসকারী আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী তথা জৈশ-এ-মহম্মদের প্রধান, এবং সংগঠনের মুখ্য ফিনান্সিয়ার, নিয়োগকর্তা, এবং প্রেরণাদায়ী শক্তি" বলে বর্ণনা করেছে এনআইএ। এ ছাড়াও আজহার "ইসলামিক স্টেট এবং আল কায়েদার" সঙ্গে মিলে সন্ত্রাসবাদী হামলার "অর্থ জোগাড়, পরিকল্পনা, এবং বাস্তবায়নে অংশীদার", বলছে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা।
আরও পড়ুন: পুলওয়ামা হামলার নেপথ্যে পাকিস্তানই, দাবি সেনার
ওই তথ্যপঞ্জিতে আরও বলা হয়েছে, "১৯৯৪-এর গোড়ার দিকে জম্মু কাশ্মীরে উদয় হয় আজহার, মূলত সেরাজ্যে সক্রিয় বিভিন্ন বিবাদমান জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যে মধ্যস্থতা করতে। ১৯৯৪-এর ফেব্রুয়ারিতে তাকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী।"
জৈশ-এ-মহম্মদের তহবিলের অর্থ আসে ব্যবসায়িক স্বার্থ থেকে, এবং তথাকথিত ইসলামি দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে। এনআইএ-র চার্জশিট অনুযায়ী, জৈশের অগ্রভাগে রয়েছে আল রহমত ট্রাস্ট, যা নিহত জঙ্গিদের পরিবারবর্গকে সাহায্য করার অছিলায় টাকা তোলে, এবং লাহোর, পেশাওয়ার ও করাচিতে মসজিদ নির্মাণ করার জন্য জমির আবেদন জানিয়েছে।
চার্জশিটে আরও বলা হয়েছে, জৈশের দুই অনলাইন মুখপত্র আল-কামা এবং রং-ও-নূর, যেগুলি নিয়মিত ভারত বিরোধী প্রচার চালায়, করাচি থেকে পরিচালিত হয় বলে জানা গেছে।