Advertisment

CAA: আশা-ভরসা চুরমার, সিএএ-তে জীবন আরও জটিল! হায়-হায় করছেন অসমের বরাকের হিন্দু বাঙালিরা

Citizenship Amendment Act 2019: সিএএ কার্যকর হয়েছে। কিন্তু, অন্ধকারই যেন ভবিতব্য অসমের শরণার্থী হিন্দু বাঙালিদের। এখন কী করবেন তাঁরা?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
In Assams Barak Valley Bengali Hindus find CAA is not all they hoped it would be , আশা-ভরসা চুরমার, সিএএ-তে জীবন আরও জটিল! হায়-হায় করছেন অসমের বরাকের হিন্দু বাঙালিরা

Assam: শিলচর থেকে ৩০ কিমি দূরে অমরাঘাট বাজার এলাকায় নিজের দোকানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন হিন্দু বাঙালি শরণার্থী পরিবারের সদস্য অজিত দাস। এক্সপ্রেস ফটো

Assam's Barak Valley Bengali Hindus On CAA: অসমের হিন্দু বাঙালিদের এ যেন শাখের করাত! ভেবেছিলেন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর হলে সব দুঃখের অবসান হবে। ভারতীয় তকমা নিশ্চিৎ হবে। কিন্তু, আশা ভেঙে চুরমার! সিএএ যেন আরও জটিল করে দিয়েছে এক সময়ে শরণার্থী হয়ে এ দেশের আসমে ঢুকে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার উদ্বাস্তু বাঙালিদের জীবন। যেন চোখের জলই তাঁদের সঙ্গী। এঁদের অপেক্ষার পালা আরও বাড়ল।

Advertisment

অসমের শিলচর থেকে ৩০ কিমি দূরে বসবাস হিন্দু বাঙালি অজিত দাসের। ভারতের নাগরিক পরিচয় নিশ্চিতে তাঁর অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সাল থেকে। তখনই প্রথম নোটিস পান যে, তাঁর নাগরিকত্ব তদন্তাধীন। ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণে গত ১০ বছর অজিতের সংগ্রামের মধ্যে রয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি দশাও। অনেক কিছুর পরও ২০২১ সালে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল অজিত দাসকে বিদেশি বলে ঘোষণা করে দেয়।

অজিত দাস বলেছেন যে তাঁর বাবা এবং দাদা ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে অসমের হাইলাকান্দি জেলার মোনাচেরার একটি শরণার্থী শিবিরে কয়েক মাস কাটিয়েছিলেন। এখানে তাঁদের একটি শরণার্থী শংসাপত্র দেওয়া হয়েছিল, এটাই দাস পরিবারের শরণার্থী হয়ে ও দেশে আসার একমাত্র নথি যা অজিতের কাছে ছিল। তবে, এই গুরুত্বপূর্ণ নথিটি শিলচরের ৬ নং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে,সরকারের কাছে ওই শরণার্থী শংসাপত্রের কোনও সংশ্লিষ্ট রেকর্ড নেই।

সদা হাস্যময় মানুষ অজিত, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন গৌহাটি হাইকোর্টে। সেই মামলা এখনও চলছে। হতদ্যম হওয়ার জোগাড় অজিতের। বলছিলেন, 'আমার দু'টি ছেলে আছে> আমি আমার নাম ভারতীয় নাগরিক হিসাবে নিশ্চিৎ করতে মরিয়া, কারণ আমি যদি তা না করি তবে এই বোঝা আমার সন্তানদের উপর পড়বে।'

আরও পড়ুন- Abhishek Banerjee: ভোটের আবহে অভিষেককে ইডি-র দিল্লি তলব নিয়ে বড় নির্দেশ, কী জানাল সুপ্রিম কোর্ট?

গত ১১ মার্চ সিএএ কার্যকর হয়েছে। যা নিয়ে বিস্তর আশা ছিল অসমের হিন্দু শরণার্থীদের। কিন্তু, বর্তমানে এইসব হিন্দু বাঙালিরা বিভ্রান্ত। সিএএ নিয়ম অনুযায়ী, কোনও আবেদনকারীকে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের নাগরিক প্রমাণ করার জন্য সিএএ নিয়মের তফসিল ১-এ-এর অধীনে অন্তত একটি নথির প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে একটি পাসপোর্ট, জন্ম সনদ, শিক্ষার সনদ, পরিচয়পত্র, জমি বা ভাড়ার রেকর্ড বা বাংলাদেশ সরকারের অন্য কোনও নথি যাতে প্রমাণ করা যায় যে আবেদনকারী ব্যক্তি সে দেশের দেশের নাগরিক ছিলেন। বিকল্পভাবে, তিনি একটি নথি উপস্থাপন করতে পারেন যাতে দেখানো হয় যে- তাঁর বাবা-মা, দাদা-দাদি বা প্রপিতামহের মধ্যে একজন বাংলাদেশের নাগরিক বা ছিলেন।

অজিত দাস এরকম কোনও নথি খুঁজে পাননি। বিষয়টি খবুই কঠিন বলে মনে করছেন শরণার্থী হিন্দু বাঙালিরা। অজিতের কথায়, 'আমি বিদেশি নই। আমি এ দেশে জন্মেছি, এখানে স্কুলে গিয়েছি, এবং আমি ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আমার সমস্ত নথির ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। হ্যাঁ, আমার বাবা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন কিন্তু কীভাবে এসেছিলেন সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। আমার কাছে একমাত্র নথি রয়েছে, যেটা হল শরণার্থী শংসাপত্র এবং এটি ইতিমধ্যেই ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই বুঝতে পারছি না সিএএ কীভাবে আমাকে সাহায্য করবে।'

অজিত দাস আসমের বরাক উপত্যকার কেন্দ্রস্থল শিলচর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে আমরাঘাট বাজারে একটি ছোট স্টেশনারি দোকান চালান। এই অঞ্চলে বেশিরভাগ বাসিন্দাই বাঙালি। ২০১৯ সালে ডিসেম্বরে সংসদে সিএএ পাস হওয়ার ফলে অসমজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল, আন্দোলনকারীরা ছিলেন মূলত অসমীয়া ভাষী ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মানুষ। তবে সেসময় এর উল্টো প্রভাব দেখা যায় বাঙালি-অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দিতে।

এই অঞ্চলটিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ১২৫ কিলোমিটারেরও বেশি আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, দেশভাগের পরে একটি বৃহৎ বাঙালি হিন্দু জনসংখ্যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এখানে চলে এসেছিল। সেখানকার অনেকেই বিশ্বাস করেছিল যে যেসব শরণার্থী হিন্দু বাঙালি এনআরসি-তে বাদ পড়েছিল এবং বিদেশি ট্রাইব্যুনালে মামলার মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁদের জন্য সিএএ স্বস্তি আনবে।

আরও পড়ুন- Mahua Moitra: আরও বিপাকে মহুয়া! বহিষ্কৃত সাংসদের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ লোকপালের

কিন্তু এখন যেহেতু সিএএ প্রক্রিয়া পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, শরণার্থী ভোটাররা বুঝতে পারছেন যে তাঁরা যা আশা করেছিল তা হয়নি। আসাম বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাসুদেব শর্মার কথায়, 'আমরা আন্দোলন করেছি, আইনের সমর্থনে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছি। কিন্তু সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের নিয়মগুলি বিশ্লেষণ করার পর, একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আবেদনকারীদের পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের একটি নথির প্রয়োজন রয়েছে এবং তাঁদের প্রবেশের তারিখ নির্দিষ্ট করতে বলতে হবে। কিন্তু এইসব শরণার্থীরা এমন লোক যাঁরা কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই প্রাণভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে কোনওমতে ভারতে পৌঁছেছিল। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছি। আবেদন করেছি যেন নিয়মগুলি সংশোধন করা হয়। নথি ছাড়াই মানুষের কাছ থেকে স্ব-ঘোষণা যথেষ্ট হওয়া উচিত। আরেকটি বিষয় হল আবেদনকারীকে আবেদনের সময় বলতে হবে তারা বিদেশি। এটা নিশ্চিত করা উচিত যে, যাঁরা এই ধরনের ঘোষণা করবেন যেন তাঁদের নারগিকত্ব সুরক্ষিত থাকে।'

কমল চক্রবর্তী, বরাক উপত্যকার নাগরিকত্ব ইস্যুতে কাজ করা একজন সমাজকর্মী, তাঁর সমালোচনায় আরও সরাসরি। কমলবাবুর কথায়, 'আমি যে দু'টি জিনিসের পক্ষে কথা বলছিলাম তা হল দেশভাগের শিকারদের নিঃশর্ত নাগরিকত্ব এবং জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব। এখানে, এই জিনিসগুলির কোনটিই মঞ্জুর করা হচ্ছে না। অসমম বিভিন্ন নাগরিকত্বের অনুশীলন চলছে - ১৯ লক্ষ লোককে এনআরসি করে থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যার বিরুদ্ধে শত শত মামলা চলছে হাইকোর্টে। যা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সন্দেহজনক ভোটার হিসেবে চিহ্নিত মানুষ আছন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে, যাঁদের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এই সমস্ত লোকেদের জন্য সিএএ এর অর্থ কী? যাঁরা এতদিন নিজেদের ভারতীয় প্রমাণ করার চেষ্টা করে চলেছেন তাঁরা ফের কেন নিজেদের বিদেশি বলে ঘোষণা করবেন?'

সম্প্রতি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার করা সিএএ বিরোধী মন্তব্যও সে রাজ্যের শরণার্থী বাঙালিদের মনে ভয় আরও গাঢ় করেছে। আসাম বেঙ্গলি হিন্দু অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাসুদেব শর্মার দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, '২০১৯ সালের অগস্টে চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। তখন ১৯ লক্ষ লোক নাগরিকত্ব থেকে বাদ পড়েছিলেন। বাদ পড়াদের মধ্যে প্রায় ৫-৬ লাখ হিন্দু বাঙালি। যাঁরা ১৯৭১ সালের আগে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে তৎকালীন পূ্র্ব পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলেন। সেইসব বাঙালি হিন্দুদের দুর্দশার সমাধান হিসাবে বিজেপি সিএএ-র পক্ষে ওকালতি করছিল। আমরাও তাতে শামিল হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এতে রাজ্যে বিজেপির ভালো ভোটার ভিত্তি গড়ে উঠবে। কিন্তু এখন তো তা উল্টো মনে হচ্ছে।'

করিমগঞ্জে অবস্থিত একজন আইনজীবী শিশির দে বলছিলেন, 'এনআরসিতে অনেককেই কেবল ত্রুটির কারণে বাদ পড়েছেন। একবার এনআরসি সূচিত হলে, তাঁরা আপিল প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে পারে এবং সফলভাবে তাদের নাম এনআরসি-তে যুক্ত করতে পারে। অন্যদিকে, যাঁরা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন এবং যাঁরা নিয়ম অনুসারে নথি দিতে পারবেন না বা যাঁদের কাছে প্রয়োজনীয় নথি নেই তাঁদের জন্য যদি একটি হলফনামা বা স্ব-ঘোষণা ব্যবস্থা থাকে তবে এটি তাদের জন্য সহায়ক হতে পারে।'

আরেক বাঙালি পিনাকি দাস, যিনি শিলচর শহরে একটি ছাপাখানা চালান, বলছিলেন যে, আমার স্ত্রী মমিতাকে এনআরসি-তে বাদ দেওয়া হয়েছিল কারণ তাঁর প্যান কার্ডে বিয়ের আগের পদবি রয়েছে এবং ভোটার তালিকায় বিয়ের পর আমার অর্থাৎ স্বামীর পদবি রয়েছে। আমাদের সিএএ নিয়ে ভাবার প্রশ্নই আসে না। আমার পরিবারের কাছে ১৯১৩ সালের কাছাড়ের জমির নথি রয়েছে, আমার দাদা অসম পুলিশে কর্মরত ছিলেন। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কারণ জানানোর জন্য অপেক্ষা করব যাতে আমরা আমাদের নথিগুলি দিয়ে সমস্যাটির সমাধান করতে পারি।'

এখন কী করবেন শরণার্থী পরিবারের সন্তান অজিত দাস? তাঁর কথায়, 'অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমি খুব স্পষ্ট নই। ভালো কথা এখানে আমি একা নই, একই নৌকায় লাখ লাখ মানুষ সওয়ার। আমরা সিএএ-এর অধীনে আবেদন করার জন্য অপেক্ষা করব। এই প্রক্রিয়ায় আমার খুব কম আস্থা রয়েছে।'

Hindu Citizenship Amendment Act Assam caa
Advertisment