পাঞ্জাবে মাদক পাচার এক ভয়ানক সংকটে পরিণত হয়েছে। একসময় মাদক ব্যবহারকারীদের তালিকায় শীর্ষে ছিল পাঞ্জাব। পাঞ্জাব সরকার এই গুরুতর সংকট মোকাবিলা করার জন্য বিশেষ টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) গঠন করা সত্ত্বেও, রাজ্যকে মাদক পাচারের মত ভয়ানক অপরাধ আজও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করার মত ঘটনা মহিলারা এই মাদক পাচারের মত অপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হচ্ছেন।
পাঞ্জাবের পাতিয়ালা জেলার ছোট গ্রাম রোহতি চান্না গ্রাম। গত বছর এই গ্রামের ১৪ জন বাসিন্দার বিরুদ্ধে এনডিপিএস আইনের অধীনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্য এখন মাদকের ব্যবহার ও পাচারের ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে যে উত্তরপ্রদেশ এখন তালিকার শীর্ষে রয়েছে। তারপরে মহারাষ্ট্র এবং পাঞ্জাব । চণ্ডীগড়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (পিজিআইএমইআর) এর কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের তরফে প্রকাশিত 'রোডম্যাপ ফর প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অফ সাবস্ট্যান্স অ্যাবিউজ ইন পাঞ্জাব' বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বলছে যে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বা পাঞ্জাবের জনসংখ্যার প্রায় ১৫.৪ শতাংশ বর্তমানে মাদক সেবন করছেন।
পাঞ্জাবে মাদক ব্যবসার অঙ্কটা প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার আশেপাশে। মাদকাসক্ত হয়ে অনেক পরিবার তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছে। তবে এটা লক্ষনীয় মাদক ব্যবসায়ের মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। বছর ১৯-এর প্রিয়াঙ্কা, গত জুনে ৮৭৫ টির বেশি 'মাদক' সহ গ্রেফতার হন। তার মা ও বোন অতীতেও মাদক রিধোধী আইনের আওয়ায় গ্রেফতার হয়েছেন। একই গ্রামের আরও তিনজন মহিলাকে ৪.৫ গ্রাম থেকে ৬০ গ্রাম পর্যন্ত হেরোইন সহ গ্রেফতার করা হয়।
এই মহিলারা পাঞ্জাবের মাদকাসক্তির গল্পের একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। যারা মাদক ব্যবসায়ে অপ্রতিরোধ্যভাবে আধিপত্য করে আসছে। ১লা এপ্রিল, ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ -এর মধ্যে পাঞ্জাব পুলিশের তরফে দায়ের করা NDPS আইনের অধীনে দায়ের করা ১১ হাজারের বেশি FIR-এর মধ্যে ১০ শতাংশ-ক্ষেত্রে মহিলারা জড়িত। এই সংখ্যাগুলি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। যখন ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে মহিলাদের বিরুদ্ধে ৯০০ টিরও কম NDPS আইনের আওতায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই সংখ্যাটি ২০১৯ সালে বেড়ে হয়েছে ১২৩৩। ২০২০ সালে করোনা সংকটের সময় এই সংখ্যা কিছুটা কমলেও তার পর থেকে ঝড়ের গতিতে বেড়ে চলেছে সংখ্যাটা।
পাতিয়ালা জেলাতেই মহিলাদের বিরুদ্ধে ১১৬ টি এফআইআর রয়েছে মাদক মামলায়। তারপরে কাপুরথালা এবং লুধিয়ানা এবং এসবিএস নগর । এফআইআরের ভিত্তিতে ১,৫৩৩ জন মহিলাকে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার তাদের মধ্যে ১৪০৮ জন বিবাহিত। পাঞ্জাব পুলিশের প্রধান, ডিজিপি গৌরব যাদব স্বীকার করেছেন যে তারা মহিলারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে আগের থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় যুক্ত হচ্ছেন। পুলিশ আধিকারিকরা বলছেন যে রাজ্যের অনেক জায়গায় মাদক ব্যবসা একটি পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। যেখানে মহিলারা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করছে৷ পুরুষরা ধরা পড়লে বা অকালে মারা গেলে তারা ব্যবসা চালান একেবারে দক্ষ হাতেই।
এর মাঝেই সামনে এসেছে এমন এক তথ্য যাতে দেখা যাচ্ছে মাদক মামলায় ধরা পড়া অধিকাংশই চুনোপুঁটি। বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাঘববোয়ালরা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে, পাঞ্জাবের কাপুরথালা জেলায় এক আস্তানায় মাদকের রমারমা কারবার চলছে গোপনসূত্রে খবর পেয়ে সাতনামপুরা থানার পুলিশ সাগর সান্ধুর বাড়িতে অভিযান চালায়। উদ্ধার করা হয় মাদক। এনডিপিএস আইনের অধীনে গ্রেফতার করা হয় তাকে।
১ এপ্রিল, ২০২২ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩-এর মধ্যে NDPS আইনের অধীনে পাঞ্জাব পুলিশের তরফে দায়ের করা ১১,১৫৬ টি এফআইআর অনুসারে দেখা যায় যে মাদক ব্যবসার মাথাদের বদলে আটক করা হয়েছে ছোটখাটো মাদক বিক্রেতাকেই।
রাজ্য পুলিশের ডিজি গৌরব যাদব অবশ্য বলছেন এই প্রবণতা বদলে যাচ্ছে৷ “আমরা এই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক টন হেরোইন বাজেয়াপ্ত করেছি, যা রাজ্যের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এবং আমরা এই বছর অনেক বড় মাথাদের ধরেছি।”
তিনি বলেছেন, “রাজ্যকে মাদক সংকট থেকে বের করে আনার জন্য কেবল মাথাদের নয় যারা অল্প পরিমাণে মাদক বিক্রি করছে তার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান এর স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় তিনি রাজ্যকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি সেই বক্তৃতায় বলেছিলেন আমাদের অবশ্যই রাঘববোয়ালদের ধরতে হবে। তাদের জেলে রাখতে হবে।''
এনডিপিএস আইনে ৫ গ্রাম হেরোইনকে স্বল্প পরিমাণ এবং ২৫০ গ্রাম বাণিজ্যিক পরিমাণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। গাঁজার জন্য, ১ কেজি স্বল্প পরিমাণ, এবং ২০ কেজি বাণিজ্যিক পরিমাণ। এই পরিসরের মধ্যে মাদককে আইনি পরিভাষায় "বাণিজ্যিক পরিমাণের চেয়ে কম কিন্তু স্বল্প পরিমাণের চেয়ে বেশি" বা "মধ্যবর্তী" পরিমাণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
ডঃ সন্দীপ ভোলা, যিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কাপুরথালায় মাদক মুক্ত করার কেন্দ্র চালাচ্ছেন, বলেছেন, “পুলিশ মাদক সেবনকারীদের গ্রেফতারের পরিবর্তে তাদের রিহ্যাব সেন্টারে পাঠাতে পারেন। এটাই মাদক মুক্তির দুষ্ট একমাত্র উপায়।’’
চলতি বছরের মার্চ মাসে বিধানসভায় ভাষণ দেওয়ার সময়, রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ বলবীর সিং তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন যে পাঞ্জাবে প্রায় এক মিলিয়ন মাদক সেবনকারী রয়েছে। প্রসঙ্গত, মাদক সেবনকারীর এত বড় জনসংখ্যার রাজ্যে মাত্র ৩৬টি সরকারি আসক্তি মুক্ত কেন্দ্র রয়েছে।
পাঞ্জাবের প্রাক্তন ডিজিপি (কারাগার) শশিকান্ত, একজন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার, বলেছেন যে এটি দুর্ভাগ্যজনক যে কোনও ক্ষেত্রে অগ্রগতি গ্রেফতারের সংখ্যা দ্বারা পরিমাপ করা হয়। “অভিযুক্তদের পুনর্বাসনে ফোকাস করা উচিত যাতে তারা আবার এই পথে ফিরে না আসে। আমি সাহস করে বলতে চাই যে এই মামলাগুলির অনেকগুলি ভুয়ো। আমি কেন এটা বলছি কারণ অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরেও এনডিপিএস আইনে মামলা করা হয়। অনেক সময়, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের সম্পত্তি দখল করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। অনেক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাও এনডিপিএস আইনে দায়ের করা হয়েছে।” বলবীর সিং, সুলতানপুর লোধির লাতিয়াওয়াল গ্রামের পঞ্চায়ের প্রধান এবং কংগ্রেসের এক সদস্য, নিজেকে এই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকার বলে দাবি করেছেন।