Advertisment

অগ্নিপথ: সেনায় কাজের স্বপ্ন দেখা গ্রামে এখন শুধুই অনিশ্চয়তার মেঘ, নজরে বিকল্প

বুলন্দশহরের সৈয়দপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছোট ছোট ছেলেরাই তাদের দাদা, বাবা এবং ভাইদের মতো সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
In village of fauji dreams insecurity over Agnipath

অগ্নিপথ প্রল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

“সরকার এখন এতই কঠোর যে হয় বলডোজার চলবে, নয়তো ক্যারিয়ার খারাপ হবে। এই সরকার বাহুবলী, মানুষকেই নত হতে হবে।” এই মন্তব্য বুলন্দশহরের সৈয়দপুর গ্রামের প্রধান বছর ৩৭-এর অমিত সিরোহির। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছোট ছোট ছেলেরাই তাদের দাদা, বাবা এবং ভাইদের মতো সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।

Advertisment

গ্রামে প্রায় দু'হাজার পরিবারের বাস। অমিত সিরোহির কথায় এই দু'হাজারের মধ্যে কমপক্ষে ৮০০টি পরিবারেরই এমন কেউ আছেন যাঁরা সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করেছেন বা করছেন।

সরকার শসস্ত্র বাহিনীতে অফিসার পদমর্যাদার অধস্তন কর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্নিপথ প্রকল্প ঘোষণা করেছে। এই প্রকল্পে নিয়োগ করা জওয়ানদের বলা হবে অগ্নিবীর। এঁদের কাজের মেয়াদ চার বছর। নয়া প্রকল্পে প্রতি বছরপ্রায় ৪৫ হাজার সৈন্য নিয়োগ করা হবে। এঁদের মধ্যে থেকে ২৫ শতাংশকে নেওয়া হবে সেনার স্থায়ী ১৫ বছরের চাকরিতে। অগ্নিবীরদের কাজের মেয়াদ শেষে পেনশন নেই। পাবেন না সেনার অন্য কোনও সুযোগ-সুবিধাও।

গত মাসে কেন্দ্র অগ্নিবীর প্রকল্পে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগের ঘোষণা করা মাত্রাই দেশের বিভিন্ন অংশে বিক্ষোভ শুরু হয়। বেশ কয়েকটি রাজ্যে তা হিংসার আকার ধারণ করে। আলিগড়ে একটি পুলিশ ফাঁড়ি এবং গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। ট্রেনের স্টেশনে হামলা চলে। সড়ক পথ অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। শত শত বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল এবং কমপক্ষে ৯ জন সেনা কোচিং সেন্টার অপারেটরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা মূলত চাকরিতে নিরাপত্তাহীনতাকেই সমস্যা বলে মনে করছেন।

১৪ বছরের শিব সিরোহির দাদা এবং বাবা উভয়ই সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন। কিন্তু প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অগ্নিপথ প্রকল্পে নিয়োগের ঘোষণায় অথৈ জলে শিবের ভবিষ্যত। এমনটাই মনে করছে সে। শিবের কথায়, “আমি সবসময় ফৌজি হতে চেয়েছি। আমি কখনই অন্য ক্যারিয়ারের কথা ভাবিনি। আমি সকালে দৌড়াই স্ট্যামিনা তৈরি করতে। কিন্তু নতুন অগ্নিপথ প্রকল্পে স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে। এই প্রকল্পে এই গ্রামের অনেক মানুষের স্বপ্ন টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। আমার এখনকার এত কসরত মাত্র চার বছরের জন্য, তাও আবার এতে কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমার বাবা-মাও খুবই বিভ্রান্ত।”

জাট-অধ্যুষিত এই গ্রামে, যে পরিবারগুলির ছেলেরা কয়েক প্রজন্ম ধরে সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরি করেছে তারা বেশিরভাগই বাংলোতে থাকে। বাকিরা স্থায়ী বাড়িতে থাকেন। এখানে দুটি ব্যাংক, একটি ইন্টার কলেজ এবং একটি ডিগ্রি কলেজ, পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি পোস্ট অফিস, একটি ছোট হাসপাতাল এবং একটি পশুচিকিৎসা হাসপাতাল রয়েছে। গ্রামবাসী এই উন্নয়নের জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে কৃতিত্ব দেয়।

গ্রামের মাঝখানে একটি শহিদ স্মারক রয়েছে। এই গ্রাম থেকে ফৌজে কাজ করতে যাওয়া যেসব ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের নাম ওই স্মৃতিসৌধে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে উল্লেখ, “এই গ্রাম থেকে ১৫৫ জন ১৯১৪-১৯ সালের মহাযুদ্ধে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ২৯ জন তাঁদের জীবন দিয়েছেন।”

“আমরা এই ধরণের সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি। এখানে প্রতিটি ছেলে সৈনিক হতে চায়। কিন্তু অগ্নিপথের ঘোষণায় এখন হঠাৎ করেই আমাদের চিন্তা বেড়েছে।” বলছিলেন মজদুর বাবার সন্তান ১৭ বছর বয়সী আশিস। দুঃখের সঙ্গে তাঁর দাবি, “সেনাবাহিনীই আমার জন্য চূড়ান্ত গন্তব্য হওয়ার কথা ছিল। আমি কখনই ভাবিনি যে এর পরে আমাকে অন্য চাকরি খুঁজতে হবে। এখন, অগ্নিবীরদের জন্য বরাদ্দ ২৫ শতাংশ স্থায়ী কমিশন কোটায় নির্বাচিত না হলে আমি কী পাব? আমাকে যদি চার বছর পর পুলিশ বা গার্ড হতে হয়, তাহলে আমি কেন প্রথম থেকেই তা করব না?”

গ্রামের শ্রমিক ও ভূমিহীন কৃষকদের বেশির ভাগই জাটভ সম্প্রদায়ের, এইসব পরিবারের ছেলেরা সেনার চাকরিকেই সবচেয়ে ভাল বলে মনে করে। অহ্নিপথের ঘোষণায় এঁদের নিরাপত্তাহীনতা কয়েকগুণ বেড়েছে। ২১ বছর বয়সী হরিশ কুমার বলেন, “সরকার বলছে, যে অগ্নিপথ প্রকল্পে নির্বাচিত হবে সে চার বছর পর কমপক্ষে ১১ লাখ টাকা পাবে। আমি কি ওইটুকু টাকা দিয়ে বাড়ি বানাতে পারব? জমি কিনতে পারব? উত্তর- না। বড়লোক কৃষকদের জন্য এটা সহজ, কিন্তু আমাদের মত ছোট চাষীর ছেলেদের কথা ভাবা হল না। আমরা কী করব?" হরিশ গত দু'বছর ধরে সেনায় নিয়োগের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তবে ই গ্রামেরই সবাই সবাই শিব সিরোহি, হরিশ বা শিবের মতো অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরোধী নন। ৪৩ বছরের যশবীর সিরোহি অগ্নিপথ প্রকল্পকে বেকারত্বের প্রতিকার হিসাবে দেখেন। তার বড়দাদু এবং দাদু সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছেন এবং দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। যশবীরের কথায় “যখন কোনও চাকরি নেই। দুই বছর ধরে সেনাবাহিনীতে কোনও নিয়োগ হয়নি তখন নয়া নিয়োগ প্রকল্পে অন্তত কিছু টাকা হাতে পাবেন যুবকরা এবং তা দিয়ে একটি ছোট ব্যবসা শুরু করা যেতে পারে। কিছু না করার চেয়ে এটা অনেক ভাল।” তবে যশবীর স্বীকার করেছেন যে, তাঁর পিতার মৃত্যুর পরে, দাদুর পেনশনেই তাঁদের সরসার চলেছিল। এতসবের পরও যশবীরের ১১ বছরের ছেলে মায়াঙ্ক বড় হয়ে একজন সৈনিক হতে চায়।

গ্রামের প্রবীণরা স্বীকার করেছেন যে অগ্নিপথ প্রকল্পের জন্য যুবকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। সদ্য সেনাবাহিনীর কাজ থেকে অবসর নেওয়া এক ব্যক্তির কথায়, "তরুণরা গেরে গিয়েছে। প্রতিবাদ তাই স্বাভাবিক। স্বপ্ন ভেঙে খান খান হলেও কেউ প্রতিবাদ করতে পারবে না? বিজেপি নেতারা বলেছেন, ছেলেরা চার বছর পর অবসর নিলে পুলিশ বা গার্ডের কাজ পাবেন। যে ছেলে চার বছর দেশসেবা করেছে সে কি চার বছর পর গার্ড হিসেবে কাজ করে খুশি হবে? সেনাবাহিনীতে চাকরি গর্বের বিষয়, যা অন্য কোনও চাকরিতে আছে?" অবসরপ্রাপ্ত এই সেনার ছেলেও সেনা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। উপায় না দেখে সে এখন অগ্নিবীর প্রকল্পে নিয়োগের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

Agnipath protest
Advertisment