জাহাঙ্গিরপুরীতে উত্তর দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সাম্প্রতিক উচ্ছেদ অভিযান রীতিমতো সাড়া ফেলেছে। কিন্তু, উচ্ছেদ অভিযান জাহাঙ্গিরপুরীতে নতুন কিছু না। জন্মলগ্ন থেকেই এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে উচ্ছেদের চেষ্টার ইতিহাস। সাতের দশকের মাঝামাঝি সঞ্জয় গান্ধীর নগরোন্নয়ন পরিকল্পনা ঘিরে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। জরুরি অবস্থা এবং তার পর ৮২ সালের এশিয়ান গেমসের আগে দিল্লি থেকে বহু বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছিল। উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের অন্যত্র পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। যা থেকেই জন্ম নিয়েছিল জাহাঙ্গিরপুরী এলাকায় দখলদারির অভিযোগ।
সঞ্জয় গান্ধীর পরিকল্পনামতো দিল্লির সৌন্দর্যায়নের দুটো বিষয় ছিল। এক, আধুনিক স্টেডিয়াম তৈরি। উড়ালপুল তৈরি, চওড়া রাস্তা বানানো, ইত্যাদি। দ্বিতীয়টা, দিল্লির কেন্দ্রস্থল থেকে বস্তি উচ্ছেদ। এশিয়ান গেমসের মূল আয়োজন হওয়ার কথা ছিল। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হ্যাজার্ডস সেন্টারের ডিরেক্টর দুনু রায় জানিয়েছেন, '১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬, এই একবছরে সেই সময় প্রায় দু'লক্ষ লোককে মধ্য দিল্লির বস্তি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এর ফলে বস্তির সংখ্যা ২,০০০ থেকে কমে ১,১০০-য় এসে ঠেকেছিল।' যে ৩০-৪০টি পুনর্বাসন করোনি তৈরি হয়েছিল, সেগুলোও অবশ্য দিল্লি শহরের মধ্যেই। তার মধ্যেই রয়েছে জাহাঙ্গিরপুরী, মঙ্গলপুরী, দক্ষিণপুরী, ত্রিলোকপুরী, সীমাপুরী, এরকম আরও কয়েকটা।
দিল্লির ঐতিহ্য বিষয়ের গবেষক সোহেল হাশমি জানিয়েছেন, জাহাঙ্গিরপুরী আগে দিল্লির প্রান্তে একটা গ্রাম ছিল। ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের নামানুসারে এই গ্রামের নামকরণ করা হয়। দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথরিটির ভাইস চেয়ারম্যান জগমোহন মালহোত্রার জমানায় এখানে উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলেছিল। পুনর্বাসন কলোনিতে পরিবারপ্রতি ২৫ গজের জমি মাপা হয়েছিল। আর ভর্তুকিমূল্যে বাসিন্দাদের দেওয়া হয়েছিল সেই জমি। দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথরিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান একে জৈন জানিয়েছেন, বস্তির জনসংখ্যা দিল্লির এক বিরাট সমস্যা। তিনি বলেন, ' দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাঁরা দিল্লিতে কাজের সন্ধানে আসেন, তাঁরা বেশিরভাগেই বেসরকারি কাজ করেন। তাঁদের ভর্তুকিমূল্যে দিল্লিতে নিজস্ব জমির ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথিরিটি।'
আরও পড়ুন- নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, কেন্দ্রকে বুধবার পর্যন্ত সময় আদালতের
যদিও সেটা করতে গিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। এমনকী, রাতভর বুলডোজারও চালাতে হয়েছে দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথিরিটিকে। এমনকী, আদালত থেকে আনা স্থগিতাদেশও অনেক সময় মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। আর, দিল্লির বস্তিবাসীদের বারবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। হ্যাজার্ডস সেন্টারের ডিরেক্টর দুনু রায় জানিয়েছেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ সাল- এই তিন দশকে নতুন দিল্লিকে গড়ে তুলতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রমিকরা দিল্লিতে এসেছিলেন। তিন দশক পর কাজ শেষ হয়ে গেলেও তাঁরা দিল্লিতেই থেকে যান। ধীরে ধীরে পেশা পরিবর্তন করেন। তবে, সেই সব কাজ দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি।
দুনু রায় বলেন, 'দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে যাঁদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের ৮০ শতাংশ নতুন বাসা ছেড়ে মূল দিল্লিতে কাজের খোঁজে ফিরে এসেছিলেন। তখনও যে সব বস্তিগুলো দিল্লিতে রয়ে গিয়েছিল, তাঁরা সেখানে আশ্রয় নেন।' আর, পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক খারাপ অবস্থার জন্য বহু পরিযায়ী শ্রমিক এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের একাংশও দিল্লিতে চলে আসেন। ১৯৯০ সাল থেকে যাকে ঘিরে বদলে যায় দিল্লির রাজনীতি। এই সব বাঙালিকে বাংলাদেশি উদ্বাস্তু বলে চালানোর চেষ্টা শুরু করেন একশ্রেণির রাজনীতিবিদ। যা থেকে জন্ম নিয়েছে দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীর নতুন টানাপোড়েন।
Read story in English