বারো বছর ধরে নিরাপত্তাবাহিনী বিশ্বাস করে আসছে যে তারা কাশ্মীর থেকে জৈশ এ মহম্মদকে মুছে দিতে পেরেছে। একাধিক হামলা চালিয়ে তাদের প্রথম সারির নেতাদের সরিয়ে দিতে পেরেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারির আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যুর পর সন্ত্রাসবাদী এই সংগঠন ফের ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে খাদের কিনারে নিয়ে এল।
মাসুদ আজহার। জৈশ এ মহম্মদ প্রধান। পাকিস্তানে আশ্রয়প্রাপ্ত এবং চিনের দ্বারা সংরক্ষিত মৌলানা মাসুদ ১৯৯৪ সালে গোটা একটি মাস কাশ্মীরে অতিবাহিত করেছিল। ২০০১ সালের সংসদ হামলা, ২০১৬-র জানুয়ারির পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে হামলা এবং ২০১৬-র সেপ্টেম্বর উরি হামলার মাস্টারমাইন্ড এই মাসুদ। কাশ্মীর উপত্যকায় জৈশের আত্মঘাতী হামলা, গাড়িবোমা হামলার মত ঘটনার সূচনা তার নেতৃত্বেই ঘটেছে। কাশ্মীরের সাম্প্রতিক সব কটি হামলার পিছনেই জৈশ রয়েছে বলে সন্দেহ।
আফগানিস্তানে পাক সহায়তা তালিবানরা যখন আলোচনার জন্য এগিয়ে আসছে, সে সময়েই কাশ্মীরে হামলার পরিমাণ বাড়ছে। জৈশের সঙ্গে আফগান তালিবানদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর যুদ্ধের পর যখন আলোচনা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সে সময়েই কাশ্মীর হামলা আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী এবং তালিবানের নিজস্ব লোকজনের কাছে বার্তাবহনকারী।
আরও পড়ুন, বিদেশ মন্ত্রক ও সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইট হ্যাক, দায়ী ভারত, অভিযোগ পাকিস্তানের
নিরাপত্তাবাহিনীর হিসেবে কাশ্মীরে যেসব জঙ্গি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তাদের মধ্যে জৈশ তৃতীয় বৃহত্তম সংগঠন, তাদের চেয়ে বড় দুটি সংগঠন হল হিজবুল মুজাহিদিন এবং লশকর-এ- তৈবা। কিন্তু কাশ্মীরে গত দু বছর ধরে যে সব মারাত্মক হামলা হয়েছে, তাদের প্রায় সবকটির পিছনেই রয়েছে জৈশ। গত এক বছরে তাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কম্যান্ডারসহ ৪০ জনেরও বেশি মারা যাওয়া সত্ত্বেও তাদের শক্তিতে খুব বেশি দাঁত ফোটানো যায়নি।
১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের মাধ্যমে ছাড়া পায় মাসুদ
পুলিশ রেকর্ড অনুযায়ী উপত্যকায় ৫৬ জন জৈশ জঙ্গি রয়েছে, এদের মধ্যে ৩৩ জনই পাকিস্তানি, ২৩ জন স্থানীয়। এদের মধ্যে ১৯ জন বিদেশি সহ মোট ২১ জন উত্তর কাশ্মীরের তিনটি জেলায় সক্রিয়। দক্ষিণ কাশ্মীরে ৩৫জন জৈশ জঙ্গি রয়েছে, তাদের মধ্যে ২১ জন স্থানীয়। মধ্য কাশ্মীরের শ্রীনগর, বুদগাম এবং গাণ্ডেরবাল জেলায় জৈশের উপস্থিতি শূন্য বলেই মনে করা হয়।
লশকর এবং হিজবুল মুজাহিদিনের উপর আন্তর্জাতিক নজরদারি থাকায় জৈশের পুনরুত্থান পাকিস্তানি রণকৌশল বলে মনে করছে পুলিশ। লশকর প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সঈদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রয়েছে, তার মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার।
২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সংসদ হামলার পিছনে জৈশের হাত বলেই সন্দেহ
গত বছরের পুলিশের নিজস্ব গোপন গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, "উপত্যকায় জৈশ মহম্মদের বাড়বৃদ্ধির একটা কারণ সম্ভবত লশকর এ তৈবা এবং তার প্রধানের ওপর ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক নজরদারি। ২০১৭ সালে বিশেষ করে লশকর এবং হিজবুল মুজাহিদিন এই দুই জঙ্গি সংগঠন যথেষ্ট ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং তাদের বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় কম্যান্ডার মারা গেছে। পাকিস্তানের হ্যান্ডলাররা উপত্যকায় জৈশ ক্যাডারদের জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছে, তাদের মূল উদ্দেশ্য হল উপত্যকায় আত্মঘাতী হামলা ঘটিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের পিছু হঠতে সাহায্য করা যাতে হিজবুল এবং লশকর এ তৈবা কিছুটা হাঁফ ছাড়ার অবকাশ পায়।"
পাকিস্তানের অন্তর্গত পঞ্জাবের ভাওয়ালপুরে জন্ম মাসুদ আজহারের। শুরুতে সে ছিল হরকত উল আনসারের সদস্য, যারা কাশ্মীরে প্রবেশের আগে আফগানিস্তানে রাশিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের মাধ্যমে যে কয়েকজন জঙ্গিদের মুক্ত করা হয়, তার অন্যতম ছিল মাসুদ আজহার।
২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি, পাঠানকোটে বিমানঘাঁটি হামলা
মনে করা হয় এর অব্যবহিত পরেই মাসুদ জৈশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। মাস দুয়েক পরে কাশ্মীরে উপত্যকার প্রথম মানব বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় জৈশ এ মহম্মদ। একটি ১৭ বছরের ছেলে বিস্ফোরক বোঝাই মারুতি নিয়ে শ্রীনগরে সেনাবাহিনীর ১৫ কর্পের সদর দফতরে হামলা উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শ্রীনগরের শহরতলির ওই স্কুলছাত্র ভয়ে তাড়াতাড়ি ট্রিগার টেনে ফেলায় সে গাড়ি গেটেই বিস্ফোরিত হয়েছিল। ওই বছরই ক্রিসমাসের দিন ওই একই জায়গায় হামলার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক বোঝাই মারুতি সহ পাঠানো হয় ২৪ বছরের এক ব্রিটিশ নাগরিককে। সে হামলায় মোট ১১ জনের প্রাণ গিয়েছিল, তার মধ্যে ছিলেন পাঁচজন সেনাকর্মীও। জৈশের নিজস্ব মুখপত্র জর্ব এ মোমিনে সেই বোমারুর পরিচিতি প্রকাশিত হয়েছিল।
এই হামলাগুলির মাধ্যমে লশকর এ তৈবার সঙ্গে তাদের তফাৎ স্পষ্ট করে দিয়েছিল জৈশ এ মহম্মদ। ইসলামে আত্মহনন নিষিদ্ধ বলে লশকর এ তৈবা আত্মঘাতী হামলা ঘটায় না।
লশকরের সঙ্গে আরও একটি তফাৎ রয়েছে জৈশের। তারা তালিবানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। পাকিস্তানের শত অসুবিধা সত্ত্বেও তারা এ যোগাযোগ রেখেই চলে, এমনকি ৯-১১ হামলার পর ইসলামাবাদের উপর চাপ সত্ত্বেও। জৈশের বিভিন্ন অপারেশনের ফলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বারংবার। ৯-১১ হামলার মাসখানেকের মধ্যেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জম্মুকাশ্মীর বিধানসভায় জৈশের আত্মঘাতী হামলা ঘটে। কাশ্মীর সন্ত্রাস শুরু হওয়ার ১২ বছর পর সে ঘটনার জেরে প্রথমবার পাকিস্তানকে সরকারিভাবে হামলার নিন্দা করে। পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক থেকে এই হামলাকে সন্ত্রাসবাদী বলে সমালোচনা করা হয়। শুধু ২৩ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুর জন্যই নয়, পাকিস্তানকে এ পদক্ষেপ করতে হয়েছিল কারণ সে ঘটনার আত্মঘাতী হামলা যে ঘটিয়েছিল, সেই ওয়াজাহাত হুসেন ছিল এক পাকিস্তানি।
আরও পড়ুন, পুলওয়ামার জের: পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক ২০০ শতাংশ
২০০৩ সালে পাক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফকে দু দুবার হত্যার চক্রান্ত করার পর থেকে পাক নিরাপত্তাবাহিনীরও সমর্থন হারায় জৈশ।
রতে নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মীরা জৈশের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেছে সংগঠনের মধ্যে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে। ২০০৪ সালের গোড়ার দিকে একজন স্পাইয়ের সাহায্যে লোলাবে আয়োজিত জৈশের একটি মিটিংয়ে হানা দেয় নিরাপত্তা বাহিনী, তাদের সমস্ত শীর্ষ নেতাকে হত্য়া করতে সক্ষম হয় তারা।
তারপর প্রায় এক দশক সময় জুড়ে জৈশ নিজেদের পা রাখার জায়গা তৈরির জন্য চেষ্টা করে গেছে, এবং সে প্রক্রিয়ায় বারবার তাদের কর্মীরা নিহত হয়েছে। ২০১১ সালের মার্চ মাসে ডাল হ্রদের তীরে নিহত হয় কাশ্মীরের জৈশ প্রধান সাজাদ আফগানি। তার সঙ্গে মারা যায় তার সহযোগী ওমর বিলাল। তিন মাস পর অন্য আরেকজন চরের সহায়তায় জৈশের আরেক কম্যান্ডারকে হত্যা করে নিরাপত্তাবাহিনী।
উরির সেনাঘাঁটিতে হামলা. ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
এরপর জৈশ কিছুটা ভারতীয়করণের চেষ্টা করে। কাশ্মীরে একটি গ্রুপ তৈরি করে তারা, তার নেতৃত্বভার দেওয়া হয় স্থানীয় আলতাফ বাবাকে। কিন্তু ২০১৩ সালের জুলাই মাসে পুলিশের হাতে আসা নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আলতাফ বাবা নিহত হয়।
বেশ অনেকটা সময় পর, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে একটি বড়সড় হামলার দায় স্বীকার করে জৈশ। কুপওয়ারায় নিয়ন্ত্রণরেখার ঠিক পাশে টাংধারে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে হামলায় নিহত হন এক সাধারণ নাগরিক। তারা এ হামলার কৃতিত্ব দেয় তাদের আফজল গুরু স্কোয়াডকে, তবে সেনাবাহিনী এবং জম্মুকাশ্মীর পুলিশ এ হামলার পিছনে তারা সত্যিই ছিল কিনা, সে নিয়ে সন্দিহান।
আরও পড়ুন, ভারতের সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের কী এসে যাবে?
২০১৬ সালে, যে সময়ে কাশ্মীরে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছিল এবং যার জেরে হিজবুল মুজাহিদিন কম্যান্ডার বুরহান ওয়ানি মারা যায়, সে সময়ে কুপওয়ারা এবং পুঞ্চ দিয়ে জৈশের দুটি গোষ্ঠী ভারতে প্রবেশ করে। নিরাপত্তাবাহিনীর দাবি, কাশ্মীরে জৈশের সেটাই পুনর্জন্ম।
জৈশের ফের বাড়বৃদ্ধির পিছনে যার হাত সবচেয়ে বেশি রয়েছে বলে মনে করা হয়, সে হল উপত্যকার তিনফুটিয়া জঙ্গি নূর মহম্মদ তান্ত্রে ওরফে নূর ত্রালি। সংসদ হামলার মূল চক্রী বলে অভিযুক্ত জৈশ কম্যান্ডার গাজি বাবার কাছের লোক বলে মনে করা হয় ত্রালিকে। ২০০৩ সালের হামলার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়, ২০১১ সালে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্যারোলে ছাড়া পেয়ে সে ফের সন্ত্রাসবাদে অংশ নেয়। ত্রালি দক্ষিণ কাশ্মীরের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর উপত্যকায় বেশ কয়েকটি বড়সড় জৈশ হামলার সঙ্গে সে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ। সূত্রের খবর অনুযায়ী নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে ত্রালির, একই সঙ্গে জৈশের সঙ্গে চোরাগোপ্তা যোগাযোগ রেখেও চলত সে- এমনটাই জৈশের তরফ থেকে ত্রালির উপর লিখিত একটি বইয়ে দাবি করা হয়েছে।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, পুলওয়ামায় এক অপারেশনে নিহত হয় ৪৭ বছরের ত্রালি।
ত্রালির জায়গায় বসানো হয় মুফতি ওয়াকাস নামের এক পাক জঙ্গিকে। সে মাসুদ আজহারের ঘনিষ্ঠ। সেনাবাহিনীর মতে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মুর সুঞ্জুওয়ান সেনা শিবিরে হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিল ওয়াকাস। এ হামলায় ৬ সেনাকর্মী নিহত হন।
২০১৭ সালে মাসুদ আজহার নিজের ভাইপো তালহা রশিদকে ওয়াকাসের অধীনে কাজ করার জন্য পাঠায়। তার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট, মাসুদ বোঝাতে চেয়েছিল সে জৈশের পুনরুত্থানের স্বার্থে নিজের লোকের রক্তক্ষয়ও সে মেনে নেবে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে সংঘর্ষে মারা যায় রশিদ। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে অবন্তীপুরায় নিত হয় ওয়াকাস।
ততদিনে ত্রালি ও ওয়াকাসের সৌজন্যে উপত্যকায় জৈশ নেতৃত্বাধীন হামলা ফের শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৭ অগাস্ট, ২০১৭র পুলওয়ামা হামলা (নিহত ১৭ নিরাপত্তারক্ষী), ৩ অক্টোবর, ২০১৭-র শ্রীনগর বিমানবন্দরের বাইরে ১৮২ নং ব্যাটালিয়নের উপর হামলা (নিহত এক বিএসএফ অফিসার), এবং ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭-র লেঠপোরায় সিআরপিএফ ট্রেনিং ক্যাম্পে হামলা (নিহত পাঁচ সিআরপিএফ কর্মী)-র পিছনে ওয়াকাসকে দায়ী করে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি।
লেঠপোরায় হামলা চালিয়েছিল ত্রালের এক পুলিশ কর্মীর ছেলে ক্লাস টেনের ছাত্র ফারদিন আহমেদ খান্ডে এবং এক স্থানীয় ট্যাক্সিচালক মঞ্জুর আহমেদ বাবা।
২০১৮-র শেষাশেষি জৈশ কাশ্মীর সংঘর্ষে নতুন এক মাত্রা জোগায়- স্নাইপার হামলা। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে নিরাপত্তা বাহিনী জৈশের একটি স্নাইপার স্কোয়াডকে নিশ্চিহ্ন করে। দেখা যায়, সে স্কোয়াডের কম্যান্ডার ছিল মাসুদ আজহারের আরেক ভাইপো, উসমান হায়দার।
এসব কিছুর মধ্যেও কর্তৃপক্ষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে ৫০ বছরের মাসুদ আজহার।
সরকারি স্কুলের হেডমাস্টারের ১১ সন্তানের একজন, ব্যক্তিগত জীবনে দুর্ধর্ষ ধার্মিক মাসুদ। করাচি মাদ্রাসায় পড়ার সময়ে তার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ হয় গরকত উল আনসারের (পূর্বতন হরকত উল মুজাহিদিন)। নিজের লেখা "জেহাদের পুণ্য" বইতে এ কথা নিজেই বলেছে সে। এরপর সে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে, তার বহু ছাত্র এবং সে নিজেও আফগান জেহাদে যোগ দিয়েছিল।
আফগানিস্তানে হরকত শিবিরে ৪০ দিনের মিলিটারি ট্রেনিং সম্পূর্ণ করতে পারেনি আজহার। তা সত্ত্বেও সে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধে আহত হওয়ার পর অনুপ্রেরণা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় মাসুদ আজহারকে। আজহারের নিজের ছেলে বড় হয়ে ওঠে মৌলানা ফজলুর রহমান খলিলের ছত্রছায়ায়। তিনি পাকিস্তানের জামিয়ত এ উলেমা ইসলামের প্রধান, তাঁর ধর্মীয় বিদ্যালয় হরকত এবং তালিবানদের সমৃদ্ধ করে আসছে। মাসুদ আজহার হরকতের সাধারণ সম্পাদক হয় এবং তাকে সেরা বক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হরকতের মাধ্যমেই কাশ্মীরে সক্রিয় হয়ে ওঠে সে।
১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে আজহারের ভারতে এসেছিল হরকত এ জেহাদি ইসলামি এবং হরকত উল মুজাহিদিনের মধ্যেকার দূরত্ব কমাতে। অন্য জঙ্গিদের মতো নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতে আসেনি আজহার। গুজরাটে জন্ম এক পর্তুগিজের ছদ্মবেশে ঢাকা থেকে বিমানে করে নয়া দিল্লিতে এসে পৌঁছয় সে। নাম নিয়েছিল আদম ইসা। প্রথমে সে দিল্লির একটি হোটেলে ওঠে। সেখান থেকে কাশ্মীরের দুই হরকত জঙ্গির সঙ্গে দেওবন্দ রওনা দেয়। পরে ফের বিমানে চেপে শ্রীনগর গিয়ে হরকতের দুই শীর্ষ নেতা সাজ্জাদ আফগানি এবং আমজাদ বিলালের সঙ্গে দেখা করে।
১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খানাবলে সাজ্জাদ আফগানির সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীর হাতে ধরা পড়ে মাসুদ আজহার।
কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের আগে একাধিকবার এই দুজনকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিল হরকত। এর মধ্যে ছিল ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কাশ্মীরে ট্রেকিংরত পশ্চিমি নাগরিকদের অপহরণ এবং ১৯৯ সালে জেল ভাঙার চেষ্টাও। প্রতিবারই ব্যর্থ হয় তারা। বিমান অপহরণের মাধ্যমে আজহারের মুক্তির ঘটনা তার সঙ্গে তালিবানদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অকাট্য প্রমাণ।
মুক্তির পর আজহার সমস্ত জিহাদি গোষ্ঠীগুলিকে একত্রিত করার চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত মৌলানা খলিলের সঙ্গে মতপার্থক্যের পর হরকতের মধ্যেকার নিজস্ব অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে জৈশ প্রতিষ্ঠা করে সে।
২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ হামলার পর দিল্লি ইসলামাবাদের হাতে ২০জনের একটি তালিকা তুলে দেয়। দাবি করা হয়েছিল, এদের ভারতের হাতে তুলে দিতে হবে। তালিকার শীর্ষে নাম ছিল আজহারের। পাকিস্তান আজহারকে গ্রেফতার করলেও ২০০২ সালে তাকে ছেড়ে দেয়। তার চলাফেরার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
২০০৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর মুশারফের প্রাণনাশের চেষ্টার পর পাকিস্তানের নিরাপত্তাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা থেকেও বঞ্চিত হয় সে। ৯-১১ হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে মুশারফের জোট বাঁধার কড়া সমালোচনায় বারবার মুখর হয়েছিল মাসুদ আজহার।
২০০৭ সালের জুলাই মাসে লাল মসজিদের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের নিজেদের দেশের জঙ্গিদের ভয়াবহ সংঘর্ষের সে ঘটনার পর তারা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
নয়াদিল্লি বারবার আজহারকে নিজেদের হাতে পেতে চাইলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নিজস্ব কারণে মাসুদকে চাইছে। তার প্রধান কারণ হল আজহারের সঙ্গে শেখ ওমরের যোগাযোগ। শেখ ওমর কান্দাহার বিমান ছিনতাইয়ের পর মুক্ত হলেও এখন জেলে রয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড হয়েছে ওমরের। ৯-১১ হামলার অর্থ জোগানের ব্যাপারে শেখের যোগসাজশ সম্পর্কে আরও তথ্য জোগাড় করতে চায় আমেরিকা।
এ ছাড়া আজহারের সঙ্গে আল কায়েদার যোগাযোগ কত দূর, তাও খতিয়ে দেখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওসামা বিন লাদেনের এক প্রাক্তন দেহরক্ষী আবু জিন্দল, কান্দাহারে আজহারের মুক্তির পর আল কায়েদা প্রতিষ্ঠাতার বিলাসবহুল পার্টি দেওয়ার কথা বলেছে।
আজহারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনওরকম ব্যবস্থাগ্রহণ অবশ্য আটকে রেখেছে চিন। রাষ্ট্র সংঘ মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারছে না চিনের জন্য। পুলওয়ামা হামলার নিন্দা করলেও, মাসুদ আজহার সম্পর্কিত পূর্বতন সিদ্ধান্ত বদল করেনি তারা।