Indian Freedom Struggle: ইতিহাসে উপেক্ষিত এক বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী। যিনি বদলে দিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংজ্ঞা। নাড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত। তারপরও ইতিহাসের পাতায় আজও তিনি উপেক্ষিত। তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে ১৮৮৬ সালের ২৫ মে। ছোট থেকেই লাঠিখেলা শিখেছিলেন। ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা মামলায় জড়িয়ে পড়েন। তার পরেই তাঁকে বাংলা ছাড়তে হয়। তবে ভারত ছাড়েননি। চাকরি নিয়েছিলেন ব্রিটিশদের অধীনে। দেরাদুনের ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে হেড ক্লার্ক পদে। সেখানেই পল্টন বাজারের কাচে ঘিঞ্জি ঘোসি গলিতে থাকতেন। যোগাযোগ হয়েছিল যুগান্তরের অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। জড়িয়ে পড়েছিলেন বাঘা যতীনের নেতৃত্বাধীন এক বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাজে। যোগাযোগ ছিল 'আর্য সমাজ'-এর বিপ্লবীদের সঙ্গেও।
সময়টা ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হচ্ছিল। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানাতে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সময় ১৬ বছররের এক কিশোর মহিলার ছদ্মবেশে ভাইসরয়ের দিকে দেশি বোমা ছুড়ে মেরেছিলেন। সেই কিশোর হলেন বসন্ত বিশ্বাস। হার্ডিঞ্জ বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু, জখম হন। অভিযোগ ওঠে, এই হামলার পরিকল্পনা ছিল দেরাদুনের ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হেড ক্লার্কের। বোমা বানাতেও তিনিই সাহায্যও করেছিলেন। তাঁর মাথার দাম ধার্য হয় একলক্ষ টাকা। কথিত আছে, সে সময়ে তিনি পুলিশ কমিশনারের ঠিক উলটো আসনে বসে ট্রেনে সফর করেছিলেন। কিন্তু, তাঁকে কমিশনারও চিনতে পারেননি।
এরপর সেই তিনি লাহোরে বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের গুপ্তদলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯১৩ সালে পঞ্জাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন গর্ডনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। চন্দননগর থেকে নিয়ে যাওয়া বোমা তুলে দেওয়া হয় বসন্ত গুপ্ত নামে এক বালকের হাতে। ১৩ মে লাহোরের লরেন্স পার্কে গর্ডন সাহেবের সভামঞ্চের কাছেই বোমাটি রেখে আসে ওই বালক বিপ্লবী। কিন্তু, বোমাটি গর্ডন সাহেব চলে যাওয়ার পর ফেটেছিল। তাতে অন্য এক ব্যক্তি মারা যান। পুলিশের নজরদারি এড়াতে এরপর তাঁকে লাহোর থেকে পালাতে হয়। কাশীতে যান। সেখানে শচীন্দ্রনাথ সান্যাল ঢাকা ‘অনুশীলন সমিতি’র শাখা তৈরি করেছিলেন। যার নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘ছাত্র-যুব সঙ্ঘ’। সেই সংগঠনের সদস্যদের সুবলদহের ছেলেটি অস্ত্র চালানো আর বোমা নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ দিতেন। এই সময় সুরেন্দ্রনাথ দত্ত ও নরেন্দ্র সেন নামে অমৃতবাজার পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন।
সেই সময় গদর পার্টির চার হাজার সদস্য আমেরিকা থেকে বিদ্রোহের জন্য ভারতে এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯১৪ সালে ভারতীয় সেনাদের সহযোগিতায় তিনি সশস্ত্র দ্বিতীয় সিপাহি বিদ্রোহের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সংগ্রহ করা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। ১৯১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহের দিন স্থির হয়। কেন্দ্রস্থল ছিল পঞ্জাবের লাহোর। বারাণসী ও জব্বলপুর সেনা ঘাঁটিতেও বিদ্রোহের প্রস্তুতি ছিল পাকা। কিন্তু, যাঁর বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই অবাঙালি বিপ্লবী রামশরণ দাস বিদ্রোহের ৪ দিন আগে সব ফাঁস করে দেয়। ব্রিটিশ সরকার সেনা পাঠিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের অস্ত্রহীন করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪ প্রধান দপ্তরের একটিতে অকস্মাৎ হামলা চালায়। বিপ্লবীরা পালটা, ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় লাহোরে ব্রিটিশ সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। লড়াইয়ে উভয়পক্ষের অনেকে মারা যান।
প্রশাসন সমস্ত শক্তি দিয়ে এই সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র দমন করে। যা ইতিহাসে ‘লাহোর ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। এই ষড়যন্ত্রের ব্যর্থ হওয়ায় অনেক বিপ্লবীই গ্রেফতার হন। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এই সময় তিনি কাশী থেকে প্রথমে কলকাতা, পরে চন্দননগর, নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে ঘুরে বেড়ান। এরপর সশস্ত্র বিদ্রোহকে সফল করতে বেছে নেন জাপানের পথ। ১৯১৫ সালের মার্চে নানা ছদ্মবেশে রওনা দেন। নানা কৌশলে পৌঁছন জাপানে। নামেন কোবে বন্দরে। সেখান থেকে যান টোকিয়ো। পরিচয় হয় চিনা বিপ্লবী সান ইয়াৎ সেনের সঙ্গে। আলাপ হয় সামুরাই নেতা মিৎসুরু তোয়ামার সঙ্গেও। ২৭ নভেম্বর টোকিয়োতে লালা লাজপত রাইয়ের সঙ্গে সভা করেন। এই খবর রটতেই ব্রিটিশ সরকারের চাপে জাপান তাঁর বিরুদ্ধে জারি করে নির্বাসনের আদেশ।
বারবার আস্তানা পালটে, বছর তিনেক জাপানেই পালিয়ে বেড়ান। অবশেষে পুলিশের থেকে বাঁচতে সোমা দম্পতির বড় মেয়ে তোশিকোকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। গোয়েন্দাদের থেকে বাঁচতে কোথাও দু’মাস, কোথাও তিন মাস পরপর বাড়ি বদলাতেন। অধিকাংশ বাড়িই ছিল জঙ্গলের মধ্যে, নয়তো সমুদ্রের পাড় অথবা কাদাজমির ধারে। ভালো করে সূর্যের আলোও সেখানে ঢুকত না। এই পরিবেশে লাগাতার জ্বরজারি থেকে তাঁর স্ত্রী তোশিকো সোমা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। ১৯২৫ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে মারা যান। তখন তাঁর দুই সন্তান। এরপর তাঁর তৎপরতায় জাপান সরকার ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে দাঁড়ায়। ১৯৪২ সালের ২৮-২৯ মার্চ টোকিওতে তাঁর ডাকে আয়োজিত এক সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তিনি সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। ১৯৪২ সালের ২২ জুন ব্যাংককে তিনিই লিগের দ্বিতীয় সম্মেলন ডাকেন। সুভাষচন্দ্র বসুকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়।
তিনি জাপানের হাতে বন্দি ভারতীয় সেনাদের নিয়ে 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি' (আজাদ হিন্দ ফৌজ) গঠন করেন। যার দায়িত্ব দেন সুভাষচন্দ্র বোসকে। তাঁর হাতেই তৈরি বিখ্যাত নাকামুরায়া কারি। জাপানে তিনি ভারতীয় রান্নাকে জনপ্রিয় করেন। পরিচিত হন 'নাকামুরায়া বোস' নামে। প্রবাসী ভারতীয়দের একত্রিত করতে তিনি ‘ভারত মৈত্রী সমিতি’ নামে একটি সংস্থাও তৈরি করেছিলেন। ১৯৪৩ সালেই নেতাজির তৈরি স্বাধীন ভারত সরকারের (Free India Government/Provisional Government) তিনিই ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি টোকিওর বাড়িতে মারা যান। আজও প্রবীণ জাপানিদের কাছে বিখ্যাত ‘ইনদো শিশি’ বা ‘ভারতীয় বীরপুরুষ’। তিনি ঠিক কে, তা বোধহয় আর বলার দরকার নেই। আর কেউ নন, রাসবিহারী বসু।
আরও পড়ুন- আজ নেতাজিকে এদেশ হারাত না, যদি চাণক্যের একটি কথা মানা হত