১৯ জানুয়ারির ব্রিগেড মোদী জমানা শেষ করতে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ডাক দেওয়া শেষ করতে না করতেই, আরেক জায়গায় সে ডাক দিলেন আর একজন মহিলা। এই শহর কলকাতাতেই। তাঁকে নিজের নামে তেমন বেশি কেউ চেনে না। তিনি দিল্লির জে এন ইউ-য়ের হারিয়ে যাওয় ছাত্র নাজিব আহমেদের মা। ফতিমা নাফিস। যিনি বিশ্বাস করেন, নাজিব ফিরবে। ফিরবেই।
নাজিবের হারানোর পর থেকে দু বছর সময়কাল পর্যন্ত গোটা ঘটনাক্রম নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে। সে তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী উপলক্ষে কলকাতায় এসে ছিলেন ফতিমা নাফিস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের বাছাই অংশ
এই যে আপনি বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছেন, বিভিন্ন জায়গায় কথা বলছেন, এই জোর আপনি পাচ্ছেন কোথা থেকে?
মেরা বেটা। আমার ছেলেই আমার শক্তি। আমার সঙ্গে রোহিত ভেমুলার মা-য়ের হায়দরাবাদে দেখা হল, ও বেচারা খুব কাঁদছিল, ওর কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেললাম। ওর কোল খালি হয়ে গেছে। ওর ছেলেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমার তো তবু ভরসা আছে, বিশ্বাস আছে আমার ছেলে ফিরবে। ও ফিরবে। আমি জানি ও ফিরবে।
এই বিশ্বাস, এই জোর, আপনি কী করে পাচ্ছেন?
শুরুতে তো আমি কথা বলতে পারতাম না, কাঁদতেও পারতাম না। কিন্তু আমার কষ্ট তো কেউ বুঝতে পারছিল না। তারপর যখন আমি কথা বলতে শুরু করলাম, তখন পরে আস্তে আস্তে অনেকে পাশে দাঁড়াতে শুরু করি।
আপনি বলছেন আপনার ছেলেকে গায়েব করে দেওয়া হয়েছে...
হ্যাঁ, মোদী সরকার নাজিবকে গায়েব করে দিয়েছে। ওকে খুন করে নি। ওকে খুন করলে ওর মৃতদেহ দেখাত। এরকম কতজনকে তো মেরে ফেলেছে, তাদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। যদি মৃতদেহ দেখাত, তাহলে আমি কী করতে পারতাম! এতজনকে মেরে ফেলার পরও তো কারও কিছু হয়নি। হয়তো ওরা ২০১৯ সালেই নাজিবকে ফিরিয়ে এনে বলবে আমি মিথ্যে কথা বলছিলাম। কিন্তু তাই হোক, আমায় মিথ্যেবাদীই বলুক! আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিক।
আপনি বলছেন নাজিবকে এই সরকার গায়েব করে দিয়েছে। ২০১৯ সালে ফের যদি এই সরকার ক্ষমতায় আসে....
(কথা শেষ করতে না দিয়ে) এই সরকার আর আসবে না। এই সরকার ফিরে আসবে না। আমি সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছি, সবার কাছে বলছি যে একজন মায়ের চোখের জল শুকিয়ে দিচ্ছে যে সরকার, তাকে জনগণ ক্ষমা করবে না। আর শুধু এক আমিই তো নই, আরও হাজার মা রয়েছেন, যাঁদের কথা লোক জানতে পারছে না। আপনি উত্তরপ্রদেশে যান, ছোট ছোট বাচ্চাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, খুন করা হচ্ছে... এরকম আগে কখনও হয়নি।
আপনি বলছেন এই সরকারের আমলে নাজিব ফিরবে না?
দেখুন, নাজিব ফিরবে এটা আমার বিশ্বাস। আমার সঙ্গে আমার ছেলের অন্তরের বন্ধন এতই দৃঢ় যে ওর যদি কিছু হত আমি বাঁচতাম না। আমি যখন আছি, তার মানে ও-ও আছে। যদি দেখেন, আমার হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেছে, তাহলে বুঝবেন নাজিবও নেই। ঈশ্বর নিরপরাধ, নিষ্পাপ মানুষকে রক্ষা করেন। তিনি ওর খেয়াল রাখছেন।
আপনি বলেন যে আপনি গরীব পরিবার থেকে এসেছেন, তাহলে এই যে আপনার ঘোরাঘুরি, এসবের খরচ কোথা থেকে আসে?
আমি কী সে তো সবাই জানে। কেউ যদি এসব জেনে আমাকে অটো করে কোথাও নিয়ে যায়, তাহলে সে অটোর ভাড়া তো আমাকে দিতে হবে না, সে নিজেই পকেট থেকে দেবে। সেরকম ভাবেই চলছে। জেএনইউ তে যখন ছিলাম, তখন জেএনইউ-য়ের ছেলেমেয়েরা খরচ জুগিয়েছে। আমার নিজের কিছু নেই। আমার স্বামী ছিল কাঠ মিস্ত্রি। ২০০৯ সালে একটা দুর্ঘটনার পর থেকে ও আর কাজ করতে পারে না। একটা প্লট ছিল আমাদের। নাজিব জেএনইউ-তে ভর্তি হওয়ার সময়ে ৫ লাখ টাকা দিয়ে প্লটটা বিক্রি করে দিয়েছিলাম। সেই টাকাতেই অনেকটা চলছে। দিল্লিতে আমার থাকার কোনও জায়গা নেই। বদায়ুনে, আমার বাড়ি থেকে দিল্লি আসতে বাসে আট ঘণ্টা মত লাগে। সাধারণ বাসের ভাড়া ২৫০ টাকার বেশি, এসি বাসে ৪০০ টাকা। আমি কারও কাছ থেকে ধারও করতে পারি না, কোথা থেকে শোধ দেব সে কথা জানি না। কোনও একটা রাজনৈতিক দলও আমাকে এক পয়সা সাহায্য করেনি। কেন- আমি মুসলমান বলে! কেন অখিলেশ যাদব আমাকে কোনও টাকা দেননি। আমাকে উনি জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনার কী দরকার! আমি বলেছি, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা।
উত্তরপ্রদেশ সরকারও কোনও রকম সাহায্য করেনি?
আপনি খোঁজ নিন। সমাজবাদী পার্টি, বসপা, কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি কেউ কিছু করেনি। শুধু ফোটো তোলানোর জন্য এসেছে। হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ সাহায্য করেছেন।
এই যে আজ কলকাতা শহরে এত বড় একটা সমাবেশ হল, এর কথা তো আপনি জানেন। তো এরা যদি সরকার গঠন করে, তাহলে কি নাজিব ফিরে আসাটা সহজ হবে?
সরকার কে গড়বে, সেটা বড় কথা নয়। মোদী যদি চলে যায়, তাহলে মানুষের মনে, সবার মনে যে আতঙ্কের পাহাড় জমে আছে, সেটা সরে যাবে। এই আমলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বেরিয়ে এসে সাংবাদিক সম্মেলন করতে হয়েছে। ওঁর আমলে সিবিআই-য়ে এইসব ঘোটালা হয়েছে, রাতারাতি সব অদলবদল করে দেওয়া হয়েছে। আর অন্যদিকে সিবিআই আমার, এক মায়ের কষ্ট বোঝেনি। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার জন্য নাজিবের ব্যাপারে ঠিক মত তদন্ত করেনি। আপনার প্রশ্নের উত্তর হল, যে আসে আসুক মোদী যাক। মোদী সরকার যেভাবে ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে দিয়েছে, সেটা অসহ্য। এখন যে কেউ গেরুয়া ফেট্টি মাথায় জড়িয়ে মোদী কিংবা যোগী হয়ে যাচ্ছে। তবে চিন্তার কিছু নেই, মোদীর হাওয়া শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আপনি দেশের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অবস্থা, সবকিছু নিয়ে এত সচেতন কীভাবে! আপনি আগে বলেছেন, আপনার তেমন পড়াশুনো নেই। এটা তো দু বছরে, নাজিবের হারিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ করে তৈরি হতে পারে না।
আমার বাবা ছিলেন খবরের কাগজের এজেন্ট। আমাদের বাড়িতে ডাঁই হয়ে খবরের কাগজ আসত। অনেক কাগজ। আমি সব কাগজ পড়তাম। বিয়ের পর, আমার দাদা, আমার বাবা শ্বশুরবাড়িতে ফ্রি-তে দুটো করে কাগজ পাঠাত। আমি পড়তাম, পড়ি। খবরের কাগজেই তো পড়েছি কিসানের ছেলে ইঞ্জিনিয়র হয়েছে, বিরাট নাম করেছে, গরীবের ছেলে পড়াশোনায় দারুণ উন্নতি করেছে। এসব পড়েই তো আমার নাজিবকে নিয়ে ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখা।