"কথাটা মনে হয় নিশ্চিন্তি, আমার ঠাকুমা বলতেন সেই নিশ্চিন্তি বোধহয় আর আমরা ফিরে পাব না...মনে হয় আমরা যেন কেমন বাইরের লোক হয়ে গেছি..." এ শুধু ঋত্বিক ঘটকের ছবির সংলাপ তো নয়। দুই বাংলার ঠাকুমা দিদিমাদের গলায় এই যন্ত্রণার কথাই তো শুনেছি। বড় চেনা এই যন্ত্রণা। অথচ, আগস্টের ১৫ এলে যন্ত্রণার আখ্যানগুলো কেমন চাপা পড়ে যায়। ২০০ বছরের পরাধীনতার পর যে স্বাধীনতা হয় তো চান নি দেশের মানুষ, তা উদযাপনেই কেটে গেল সাত দশক। ইতিহাস বলল স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী। দেশ ভাগের কাহিনী, ভিটে মাটি ছেড়ে আসার গল্পগুলো কেমন দুয়োরানীর মতো অযত্নেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকল লক্ষ মানুষের বুকে দগদগে ঘা হয়ে।
ইতিহাস যাকে সুনিপুণ ভাবে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছে, তা এবার সামনে আসতে চলছে এক বঙ্গ তনয়ার হাত ধরে। খুব শিগগির। তিনি ঋতুপর্ণা রায়। দেশভাগ নিয়ে কলকাতায় এক সংগ্রহশালার ইচ্ছে ঋতুপর্ণার তরুণ বয়স থেকে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতক স্তরে পড়ার সময়ে, কলকাতা থেকে স্নাতকোত্তর করার সময়েই দেশ ভাগের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শুরু। তবে ভবিষ্যতে এই বিষয় নিয়েই কিছু করতে হবে, এমন চিন্তা তখনও মাথায় আসে নি। এ শহরে অধ্যাপনা ছেড়ে দীর্ঘ দশ বছরের প্রবাসে হল্যান্ডে বসবাসের সময় আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে ভাবনা। বার্লিনের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল দেখে মনে হল, ওরা যদি বীভৎসতার এমন ডকুমেন্টেশন রাখতে পারে, বাংলা কেন পারে না? যন্ত্রণা তো কিছু কম নেই বাংলায়!
আরও পড়ুন, আমার দুর্গা: সুবাসিনী মিস্ত্রী
"স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তী পালনের সময় বড় বেশি করে মনে হতে থাকল, ১৫ আগস্ট দিনটা আমরা উদযাপনেই কাটিয়ে দিই, একমাত্র স্কলার এবং প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী ছাড়া কারোর মনেও থাকে না, দিনটা শুধুই পাওয়ার নয়, অনেক কিছু হারাবারও। ইতিহাসে এই অধ্যায় কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস হয়েই থেকে গেছে। নেহরু, জিন্নাহ, গান্ধী, মাউন্টব্যাটেন হয়ে রাস্তাটা শুধুই জয়ের পথে বেঁকে গিয়েছিল কি?
"দেশভাগ নিয়ে পড়তে গিয়ে আমার মনে হল, বাংলায় দেশভাগ নিয়ে সিনেমা হয়েছে, সাহিত্যও ভীষণ সমৃদ্ধ, কিন্তু দেশভাগের যন্ত্রণার ইতিহাসকে সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টা তেমন হয়নি বাংলায়। বিভিন্ন লেখা পড়তে পড়তে আমি বুঝতে পারি, একটাই বিষয়কে নিয়ে কতরকম ভাবনা থেকে কত সাহিত্যের জন্ম হয়েছে। নিজের আগ্রহ যত বাড়তে থাকল, বুঝলাম বাংলায় দেশভাগ নিয়ে একটা বড় ধরণের কাজ হওয়া খুব দরকার। ওই একই সময়ে মিউসিওলজি তে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকে। দেশ বিদেশের নানা সংগ্রহশালায় গিয়ে বুঝতে পারি, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা কোথায়," জানালেন ঋতুপর্ণা।
বালাকোট, পুলওয়ামা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, ইতিহাসের অনেক গভীরে প্রথিত আছে কারণ, এমনটাই বিশ্বাস ঋতুপর্ণার। ২০১৭ সালে দেশে ফিরেই তিনি যান অমৃতসরের পার্টিশন মিউজিয়ামে। দেশভাগ নিয়ে যে বিপুল তথ্যের ভাণ্ডার রয়েছে সেখানে, তা দেখে অভিভূত হয়ে যান। তবে দুই বাংলা ভাগ হওয়ার এবং তার পরবর্তী ভয়াবহতার ইতিহাস সেখানেও কিছুটা অবহেলিত বলেই মনে করেন ঋতুপর্ণা। সেখান থেকেই কলকাতায় মূলত বঙ্গ ভঙ্গের ওপর একটি মিউজিয়াম তৈরির তাগিদ দ্বিগুন হয়ে যায়।
সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। প্রায় বছর দুয়েক ধরে ট্রাস্ট গঠন করে রীতিমতো গবেষণা করে বানানো হয়েছে কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়াম-এর নিজস্ব ওয়েবসাইট। সম্প্রতি শহরের মানুষকে আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজেদের উপস্থিতির কথা জানিয়েছে কলকাতা পার্টিশন মিউজিয়াম। গেল মাসের ২৬ তারিখ যদুনাথ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রথম ইভেন্ট।
লজ্জা এবং গৌরব, ইতিহাস যেন দুই-ই মনে রেখে দেয়, সেই উদ্দেশ্যেই ঋতুপর্ণাদের এই প্রয়াস। যাঁরা যুদ্ধ দেখেছেন, দেশভাগ দেখেছেন, মন্বন্তর দেখেছেন, তাঁদের যেন আর একটাও পাঠানকোট দেখতে না নয়। আর যাঁরা এখনও দেখেন নি, তাদের যেন কোনোদিন ২০০২-এর গুজরাট কিমবা ২০১৯-এর পুলওয়ামা কিমবা বালাকোট, কোনোটাই দেখতে না হয়। কাশ্মীর বললেই যেন রক্ত নয়, মনে পড়ে ভূস্বর্গের নিসর্গ।