মস্কোর লুজনিকি স্টেডিয়াম আর কলকাতার আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সের মাঠ, দু'জায়গার সামাজিক এবং ভৌগলিক দূরত্ব অসীম। কিন্তু সে যেন এই দুই জায়গাকে এক সুতোয় গেঁথে দিল। 'সে' বলতে বাঙালির প্রিয় ফুটবল। তারিখটা ছিল ১৫ জুলাই। সেদিন রাশিয়ার লুজনিকি স্টেডিয়ামে বসেছিল বিশ্বকাপ ফুটবল মেগা ফাইনালের আসর। এবং এদিন আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সের মাঠে বসেছিল পাড়া ফুটবল ফাইনালের আসর। সেদিনও লুজনিকির আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। এদিনও আলিপুর বডিগার্ড লাইন্সের মাঠ বৃষ্টিতে ভিজল। এবং বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ বা সমাপ্তির মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে কলকাতার বুকে যেভাবে ফুটবল উন্মাদনা উপহার দিল কলকাতা পুলিশ, তা বেশ উপভোগ্য।
শুক্রবার আলিপুর বডিগার্ড লাইন্স গ্রাউন্ডে বসেছিল পাড়া ফুটবলের ফাইনালের আসর, যার পোশাকি নাম ফ্রেন্ডশিপ কাপ। কলকাতা পুলিশের পরিচালনায় এই প্রীতি ফুটবল প্রতিযোগিতা চলে আসছে ২০ বছর ধরে। এ কোনও মামুলি ফুটবল টুর্নামেন্ট কিন্তু নয়। এশিয়ার সবচেয়ে বড় ফুটবল টুর্নামেন্টের তকমাই শুধু পায়নি, ২০০৭ সালে লিমকা বুক অফ রেকর্ডসেও নাম লিখিয়েছে পাড়া ফুটবল। এখন পর্যন্ত ১২,৭৬০ জন ফুটবলার খেলেছেন এই টুর্নামেন্ট।
চলতি বছরের পাড়া ফুটবলে ৬৩৮টি দল অংশ নিয়েছিল। একে অপরকে টেক্কা দিয়ে শেষ পর্যন্ত হলুদ-আকাশি জার্সি গায়ে ফাইনালে ওঠে বিবেকানন্দ কলেজ (ঠাকুরপুকুর থানা)। হলুদ-আকাশির প্রতিপক্ষ হিসেবে সাদা জার্সি পরে ফাইনালে ওঠে বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংঘ (উল্টোডাঙা থানা)। ফাইনাল ম্যাচের আসর দেখে মনে হবে ঘরোয়া ম্যাচ, কারণ দর্শক বলতে শুধুই পুলিশ। আর দু'দলের কয়েকজন সমর্থক। কার্যত নিঃশব্দেই তরুণ ফুটবলারদের লড়াই দেখল আলিপুর। তবে পুলিশ মহলে এই ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা ছিলই। কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা হাতে সময় নিয়ে এই ম্যাচ দেখতে ভিড় জমিয়েছিলেন। ম্যাচের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন ভারতীয় হকি দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সন্দীপ সিং, যিনি কিনা এখন হরিয়ানা পুলিশের ডিএসপি। এছাড়াও কলকাতার নগরপাল রাজীব কুমার তো ছিলেনই। ফ্রেন্ডশিপ ম্যাচ দেখতে মাঠে এসেছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার চুনী গোস্বামীও।
এদিন খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম গোল করে বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংঘ, কিন্তু অফসাইড হওয়ায় গোল বাতিল হয়ে যায়। এর খানিকক্ষণ পর বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংঘের ফুটবলারদের চাপ বাড়িয়ে প্রথম গোলটি করেন বিবেকানন্দ কলেজের কৌশিক সাঁতরা। এরপর দু'দলের লড়াই তেমন কিছু আহামরি ছিল না। শেষবেলায় কৌশিকের ওই গোলের হাত ধরেই এ বছরের ফ্রেন্ডশিপ কাপে চ্যাম্পিয়ন হল বিবেকানন্দ কলেজ। রাজীব কুমারের হাত থেকে রানার্স আপের পুরস্কার উঠল বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংঘের ছেলেদের হাতে। অন্যদিকে সন্দীপ সিংয়ের হাত থেকে জয়ের ট্রফি নিলেন বিবেকানন্দ কলেজের ছেলেরা। প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্টের পুরস্কার উঠল বিবেকানন্দ কলেজ দলের শেখ রিন্টুর হাতে।
পরে ফুটবলারদের উদ্দেশে সন্দীপ সিং বলেন, "এটা শুরু মাত্র, আরও অনেক দূর এগোতে হবে। আপনাদের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। স্পোর্টসম্যানরা কখনও থেমে থাকেন না।" রাজীব কুমার বলেন, "শুধুমাত্র মাঠেই নয়, গোটা জীবনেও সন্দীপ যেভাবে উদাহরণ তৈরি করেছেন, আপনারও সেরকম কিছু করুন। আরও ভাল করে খেলুন।"
অন্যদিকে এদিনের ম্যাচ শেষে নতুন চমক উপহার দিল কলকাতা পুলিশ। সানি মল্লিক ও জিতু মল্লিক নামের দুই যুবককে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হল পুলিশের তরফে। কলকাতা পুলিশের শুদ্ধি প্রকল্পের আওতায় ওই দুই যুবককে মাদকাসক্তির অন্ধকার থেকে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানো হয়েছে। পাড়া ফুটবলের পাশাপাশি, শুদ্ধি প্রকল্পে কলকাতা পুলিশের এই সাফল্য যেন শেষপাতে মিষ্টিমুখের কাজ করল।