কেউ সরকারি নীতি নিয়ে সমালোচনামূলক ভাবনা প্রকাশ করলেই তাকে দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করা যায় না। খোদ আইন কমিশন এ কথা বলেছে। কমিশনের বক্তব্য, নিজের মত করে দেশের প্রতি আনুগত্য ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে প্রতিটি মানুষের।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বি এস চৌহানের নেতৃত্বে আইন কমিশনর এক প্যানেল একটি গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, যেখানে সশস্ত্র এবং বেআইনি পদ্ধতিতে সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্য রয়েছে, কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রেই কঠোর দেশদ্রোহী আইন বলবৎ করা উচিত।
ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘‘এ ব্যাপারে সরকার, অসরকারি সংস্থা, আইন বিশেষজ্ঞ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, ছাত্র-ছাত্রী এবং সর্বোপরি সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে স্বাস্থ্যকর বিতর্ক চালানো উচিত, যাতে জনমুখী একটি সংশোধনী বেরিয়ে আসতে পারে।’’
আরও পড়ুন, টাডা থেকে ইউএপিএ, ভারতের সন্ত্রাস দমন আইনসমূহ
মতপ্রকাশ ও বক্তব্যের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে প্যানেল বলেছে, ‘‘গণতন্ত্রে সবাই এক কথা বলাটা দেশপ্রেমের নিদর্শন হতে পারে না। দেশের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করার জন্য সকলেরই নিজস্ব পথ অবলম্বনের স্বাধীনতা রয়েছে। এবং সেই লক্ষ্যেই কেউ গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারেন, সরকারি নীতির ফাঁকফোকর গুলোকে চিহ্নিত করতে পারেন। তা করতে গিয়ে তাঁদের বক্তব্য কঠোর হতে পারে, যা কারো কারো কাছে অস্বস্তি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সে কারণে তাঁদের দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া ঠিক নয়। ১২৪ এ ধারা কেবলমাত্র সেখানেই প্রযোজ্য, যেখানে সরকারকে বেআইনি ও হিংস্র উপায়ে উৎখাত করাই লক্ষ্য।’’
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে ফেললেও তাকে দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া চলে না বলে মনে করছে প্যানেল। প্যানেল বলছে, ‘‘কোনও সরকারের তৎকালীন নীতির সঙ্গে দ্বিমতের পরিপ্রেক্ষিতে কেউ যদি কোনও মত ব্যক্ত করেন তাহলে তাঁকে দেশদ্রোহিতায় অভিযুক্ত করা যায় না।’’ এ ব্যাপারে উদাহরণ দিয়ে কমিশন বলেছে, গাত্রবর্ণকে সৌন্দর্যের প্রতীক ধরে নেওয়া ব্যাপারে কেউ যদি ভারতকে ‘জাতিবিদ্বেষী’ বলেন, বা কেউ যদি বলেন, ‘এ দেশ মহিলাদের জন্য নয়’, তাহলে তা দেশের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ নয়। দেশকে বা দেশের কোনও একটি বিষয়কে খর্ব করে দেখানো হলেই তাকে দেশদ্রোহিতা বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে না, তেমনটা উচিতও নয়।’’
প্যানেলের বক্তব্য, ‘‘দেশ যদি গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে না পারে, তাহলে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মধ্যে প্রায় কোনও ফারাকই থাকে না। নিজের ইতিহাসকে সমালোচনা করার অধিকার এবং অন্যকে বিক্ষুব্ধ করার অধিকার, এ দুইই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। জাতীয় সংহতিকে রক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু তার নাম করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা উচিত নয়। দ্বিমত ও সমালোচনার অধিকার একটি সচল গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ফলে মতপ্রকাশ ও বক্তব্যের স্বাধীনতায় লাগাম টানার আগে বিষয়টিকে খুঁটিয়ে দেখা দেখা প্রয়োজন, যে তার ফলে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কোনও বিধিনিষেধ আরোপিত না হয়।’’
দেশদ্রোহী আইন সংশোধন করার প্রয়োজন রয়েছে কিনা, তা নিয়ে আইন কমিশন প্রশ্ন তুলেছে, ‘‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, যেখানে আমাদের সংবিধানে মতপ্রকাশ ও বক্তব্যের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকারের মধ্যে রাখা হয়েছে, সেখানে কি দেশদ্রোহিতার বিষয়টি নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা উচিত নয়?’’