Advertisment

ছেলেধরা গুজবের পিছনে কি কোনও বৃহত্তর অভিসন্ধি?

মালদহ, দুই দিনাজপুর, বীরভূম,পশ্চিম মেদিনীপুরসহ রাজ্য়ের বিভিন্ন জায়গায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। শুধু মালদহের হবিবপুরেই অন্তত ৮টি এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
lynching, গণপিটুনি

গণপিটুনির ছবি, প্রতীকী।

সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ছেলেধরা সন্দেহে গণপ্রহারের ঘটনা। এ রাজ্যও তার বাইরে নয়। এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, গুজব ছড়ানোর হাতিয়ার হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। মালদহ, দুই দিনাজপুর, বীরভূম,পশ্চিম মেদিনীপুরসহ রাজ্য়ের বিভিন্ন জায়গায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। শুধু মালদহের হবিবপুরে অন্তত ৮টি এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অপরিচিত লোক দেখলেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু, তারপর কথায় অসঙ্গতি পেলেই মার। হবিবপুরেই এমন এক ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্য়ক্তিকে ল্য়াম্প পােস্টে বেঁধে গণপিটুনি দেওয়া হয়। মালদা মেডিক্য়াল কলেজে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। মালদার ছাতিয়ান মোড়েও একই ঘটনা ঘটেছে। যাঁদের মারধর করা হচ্ছে তাঁদের মধ্য়ে কেউ কেউ আবার মানসিক ভারসাম্য়হীন।

Advertisment

সম্প্রতি ছেলেধরা গুজবে সব থেকে বড় গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে মহারাষ্ট্রের ধুলে জেলায়। প্রায় ৪ হাজার মানুষ পিটিয়ে মেরে দিয়েছে ৫ জনকে। একসঙ্গে এত লোককে মারল কেন? তারা নাকি একটি সরকারি বাস থেকে নেমেছিল। তারপর একটি বাচ্ছার সঙ্গে কথা বলেছিল। মহারাষ্ট্র পুলিশের তদন্তে এই ঘটনা উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, ঘুরেবেড়িয়ে ভিক্ষে করাই তাঁদের পেশা। পুলিশের বক্তব্য়, এই হত্য়াকান্ডের পিছনেও সেই হ্য়োয়াটস অ্য়াপ বা সোশ্য়াল মিডিয়ার ভূমিকা। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত বিভীষিকার রূপ নিয়েছে গুজব। অসমের কারবি জেলায় ঘুরতে গিয়ে গণধোলাইয়ে মৃত্য়ু হয়েছে নিলোৎপল নামে এক ইঞ্জিনিয়ার ও ব্য়বসায়ী অভিজিৎ দাসের। এক্ষেত্রে অসম পুলিশের বক্তব্য়, সোশ্য়াল মিডিয়ায় শিশু চুরির গুজবের ফলেই এই ঘটনা ঘটেছে। সোশ্য়াল মিডিয়া প্য়ানিক তৈরি করেছে। ওই দুজন যতবারই বলেছে তাঁরা নির্দোষ কিন্তু মারধর একটুও থামেনি।

এরাজ্য়ও বাদ যায়নি ছেলেধরা গুজবের হাত থেকে। উত্তরবঙ্গে ভয় বেশি ছড়িয়েছে, কিন্তু বাদ যায়নি দক্ষিণবঙ্গও। বীরভূমের বোলপুর ও পূর্বমেদিনীপুরের তমলুকের ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মানুষ কত হিংশ্র হতে পারে। তমলুকে বিদ্য়ুৎ দফতরের ঠিকাকর্মী সঞ্জয় দত্তেক পিটিয়ে মেরে ফেলল জনতা। সেই এক গুজব ছেলে ধরা। উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় মাইকিংসহ নানা ভাবে সচেতন করার প্রয়াস অব্য়াহত। মানুষের মনুষ্য়ত্ব বোধ নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

ডাইনি সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা আকছার ঘটত বাংলার গ্রামাঞ্চলে। এখনও তা পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়নি। ডাইনি অপবাদের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পত্তি হাতানো বা অন্য় কোনও অসৎ উদ্দেশ্য় থাকত। শুধু তাই নয়, জনরোষ ঘটানো হয় চোর বদনাম দিয়েও। এসব ঘটত একেবারে এলাকা ভিত্তিক।

কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর গুজব এবং তার জেরে গণপ্রহারের এই নতুন ঘটনাপ্রবাহের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য় থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বলছেন বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়। তাঁর মতে এভাবে জনরোষকে সার্বিক রূপ দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে কোনও জায়গায় সহজেই পৌঁছানো সম্ভব। একটা গুজব ছড়িয়ে কিছুটা মজা করাও হল, কিছুটা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোও গেল, এমনটা ভাবছে অপরাধীরা। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সব ক্ষেত্রে ধরা পড়ার সম্ভাবনাও কম। উৎস খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।’’

তবে প্রশান্তবাবু আশঙ্কা, এই অপরাধের পিছনে বড় ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য় থাকতে পারে। তারা সোশ্য়াল মিডিয়ায় গুজব রটিয়ে পরীক্ষা করে দেখছে। তাদের গুজব সমাজে কতটা কার্যকরী। সফল হলে পরবর্তীতে আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। বিষয়টা খুবই ভয়ঙ্কর।’’

সহজলভ্য মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট কানেকশন এখন সারা পৃথিবীকে অতি সহজে জুড়ে ফেলেছে। মনোবিদ গার্গী মজুমদার মনে করেন, এক শ্রেণির মানুষ কোনও খবরই যাচাই করে দেখছেন না। প্রাপ্ত যে কোনও খবরকেই ধ্রুব সত্য বলে মনে নিচ্ছেন তাঁরা। তাঁর মতে, সমাজের অসহিষ্ণুতাকে কাজে লাগাতে চাইছে অপরাধীরা। মানুষের মধ্য়ে হিংস্রতা বেড়ে গিয়েছে। এর সমাধানের একটাই উপায়, সচেতনতা। পুলিশ প্রশাসনকেও এ ব্যাপারে উদ্য়োগী হতে হবে।’’

সচেতনতার কথা বলছেন প্রশান্ত রায়ও। আদতে এর কোনও সমাধান নেই। তবে  গুজবে কান দেওয়াটাই সমাধান। প্রত্য়েককেই সতর্ক থাকতে হবে। তবে আশার কথা, গুজবে কান না দেওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি।’’

Advertisment