কয়েকদিন আগের ঘটনা আজও মনে করলে শিউরে ওঠেন তিনি। জনরোষের ভয়ঙ্কর রূপ এখনও তাঁর কাছে বিভীষিকার মতো। প্রায় আড়াই হাজার মানুষের রোষ সামলে তিনি দুটো প্রাণ বাঁচিয়েছেন। যা করতে গিয়ে তাঁকেও জনরোষের শিকার হতে হয়েছে। না, তিনি কোনও আম-আদমি নন, তিনি রক্ষক হয়ে রক্ষকের ভূমিকাই পালন করেছেন। গণপিটুনির হাত থেকে দুজনকে বাঁচিয়ে তিনি খাকি উর্দির মান রেখেছেন। তিনি একজন কনস্টেবল, নাম মল্লিকার্জুন। ঘটনাস্থল কর্নাটকের বিদার জেলা। গত শুক্রবার ছেলেধরা সন্দেহে যেখানে গণপ্রহারে মৃত্যু হয়েছে মহম্মদ আজম নামে হায়দরাবাদের এক বাসিন্দার, যিনি গুগলের সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। যদিও একটা মৃত্যু ঠেকাতে পারেননি মল্লিকার্জুন, তবুও বাকি দুটো প্রাণ বাঁচিয়ে এই মুহূর্তে হিরো ওই কনস্টেবল।
আড়াই হাজার লোকের রোষ থেকে দুটো প্রাণ রক্ষা করা একেবারেই সহজ ছিল না মল্লিকার্জুনের। এজন্য তাঁকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এমনকি জনতার মার থেকে তিনিও রেহাই পাননি। গণপিটুনির ‘শিকার’দের আগলাতে গিয়ে তাঁকেও মারধরের ক্ষতের জ্বালা সইতে হয়েছে। ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন? এর জবাবে মল্লিকার্জুন জানালেন,‘‘গাড়ির সামনে প্রায় আড়াই হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রাগ দেখাচ্ছিল, কেউ আবার কটু কথা বলছিল। আমি প্রথমে জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করি। আমাদের সব অফিসাররা প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন। আমরা কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি।’’
গ্রামে ছেলেধরা এসেছে, এই গুজব রটতেই আজমদের দিকে তেড়ে এসেছিল উত্তেজিত জনতা। জনতার এহেন রূপ দেখে গাড়ি নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন আজমরা। কিন্তু গ্রামবাসীরা গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা আটকে দিয়েছিলেন। জোরে গাড়ি চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ব্রিজের কাছে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন আজমরা। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় গাড়ি। আর তখনই হাতেনাতে ‘শিকার’কে পেয়ে যায় ক্ষিপ্ত জনতা। ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল পুলিশ। জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন সার্কেল ইন্সপেক্টরও। আজম ও তাঁর বন্ধুরা ছেলেধরা বলে পুলিশের কাছে বারবার অভিযোগ করে আসছিল উত্তেজিত জনতা। এও বলা হয় যে, গাড়িতে রাইফেল রাখা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ওই কনস্টেবল বলেন,‘‘আমরা যখন দেখলাম গাড়িতে কোনও রাইফেল নেই, তখন জনতার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি, বোঝানোর চেষ্টা করি। ওদের বোঝাই যে আইনত যা করার সেটাই করা হবে, কিন্তু ওঁরা কথা শোনেননি। এমনকি এসব বলার পর , আজমদের সঙ্গে আমাদের গোপন আঁতাত রয়েছে বলে রে রে করে ওঠে উত্তেজিত জনতা।’’ মল্লিকার্জুন আরও জানিয়েছেন, যে সময়ে পুলিশ সমঝোতার পথে হাঁটা শুরু করেছিল, তখনই ক্ষিপ্ত জনতার একটি দল আজমকে গাড়ি থেকে টেনে বের করে বেদম মারধর শুরু করে। আজমকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া হয়। ক্রিকেটের উইকেট দিয়ে বেদম মারধর করা হয়। আজমের বন্ধুদেরও গাড়ি থেকে বের করতে যায় জনতার একটা দল। তাঁদের লক্ষ্য করেও পাথর ছোড়া হয়।
আরও পড়ুন, Lynching in Karnataka: ফের ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যু, ঘটনাস্থল কর্নাটক
মল্লিকার্জুন বলেন, ‘‘আজমের বন্ধু মহম্মদ সলমন, সালহাম, নূর মহম্মদ ও আফরোজকে গাড়ি থেকে বের করে মারধর করা শুরু করে উত্তেজিত জনতা। এ সময় কোনওরকমে প্রাণে বাঁচিয়ে পালিয়ে যান নূর। নূরকে পালাতে দেখে জনতার একটা দল ওঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে, ধাওয়া করে। সেসময় আমি সালহামকে রক্ষা করার চেষ্টা করি। সালহামকে বাঁচাতে গেলে ওঁরা আমাকেও মারধর করে। আমার শরীরের পেছনে অনেক ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। জনতার ছোড়া পাথর আমার চোখের কোণে লাগে, রক্তপাত হয়। যখন দেখলাম নূরকে একটা দল ধাওয়া করেছে, তখন অন্য সহকর্মীদের বললাম ওঁকে রক্ষা করার জন্য।’’
এরপর একটা ভাঙা লাঠি নিয়ে জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন মল্লিকার্জুন। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য লাঠিচার্জ করার হুমকি দেন ওই কনস্টেবল। ওই সময় এলাকায় বাইক করে একজন যাচ্ছিলেন। ওই বাইকেই নূরকে তুলে দেন মল্লিকার্জুন। এরপর সালহামকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ওই কনস্টেবল বলেন, ‘‘ওঁকে বাঁচাতে গিয়ে আধঘণ্টা ধরে আমায় জনতা মারধর করে। লাঠি, পাথর দিয়ে আমাকে মারধর করা হয়। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এরপর যখন ডেপুটি এসপি এলেন, তখন রেহাই পেলাম। উনি জনতাকে শান্ত করেন। একটা শক্ত পাথর ছোড়া হয়, যা আমার হাঁটুতে লাগে। ’’ এরপর মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন মল্লিকার্জুন। সহকর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করেন।
আরও পড়ুন, Lynchings in India: জনতা যখন খুনি!
২ সপ্তাহের মধ্যে হাঁটতে পারলে তবেই চিকিৎসকরা তাঁর হাঁটুর ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন, একথা জানিয়েছেন ওই কনস্টেবল। আজও সেদিনের ঘটনার ছবি সামনে এলে শিউরে ওঠেন মল্লিকার্জুন। কখনও ভাবেননি যে, একদিন এমন ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষী হতে হবে তাঁকে। তবে দেশে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা যেভাবে মাথাচাড়া দিচ্ছে, সেখানে দুজনের প্রাণ রক্ষা করে কনস্টেবল মল্লিকার্জুন যে নজির গড়লেন, তা বলাই বাহুল্য।