মাদ্রাজ হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়। আবেদনে কর্ণপাত না করে নিম্ন আদালতরে নির্দেশই বহাল রাখল উচ্চ আদালত। ফলে ২১৫ জন সরকারি কর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। দোষীদের প্রত্যেককে এক থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে, সঙ্গে জরিমানাও। দোষীরা সকলেই বন, পুলিশ ও রাজস্ব দফতরের কর্মী। এদের মধ্যে অনেকেই আবার আমলাও। ১৯৯২ সালের তামিলনাড়ুর ধর্মপুরী জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত ভাচাথি গ্রামে চন্দনদস্যু বীরাপ্পনের খোঁজে তল্লাশি চালায় পুলিশ ও বন দফতরের কর্মীরা। সেই অভিযানের সময় সরকারি কর্মীরা ওই গ্রামের নিরাপরাধ মহিলাদের উপর অকথ্য অত্যাচার, ধর্ষণ করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। সেই মামলাতেই ৩০ বছরের বেশি সময় বাদে দোষী সাব্যন্ত করে সাজা শোনানো হল দোষীদের।
কী দোষ?
চন্দনদস্যু বীরাপ্পনের সন্ধানে ১৯৯২ সালের ২০ জুন পুলিশের সাহায্যে কয়েক জন বনরক্ষী ভাচাথিতে অভিযান চালায়। অভিযোগ, সেই তল্লাশির সময় বীরপ্পনকে না পেয়ে বনরক্ষীরা একজন গ্রামবাসীকে বেধরক মারধর করেছিলেন। পাল্টা বনরক্ষীদেরও মারধর করে গ্রামবাসীরা। এরপর গ্রামবাসীদের পুলিশ ও বনকর্মীরা শাসিয়ে ফিরে যায়।
আদালতের নথি অনুযায়ী এর কয়েক ঘণ্টা পর ১৫৫ জন আগ্নেয়াস্ত্রধারী বনরক্ষী, ১০৮ জন সশস্ত্র পুলিশ এবং ৬ জন রাজস্ব-অফিসার বাচাতি গ্রাম ঘিরে ফেলে। শুরু হয় বীরাপ্পানের খোঁজে চিরুনি তল্লাশি। তার আগেই অবশ্য ভাচাথির বেশিরভাগ পুরুষ পালিয়ে গিয়েছিল। গ্রামে ছিলেন শুধু বয়স্ক, অথর্ব আর নারী, শিশুরা। সকলকে গ্রামের একটি জায়গায় আটক করা হয়। এরপর গ্রামের ১৮ জন মহিলাকে অন্যত্র একটি নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এদের মধ্যে অনেকে তখন কিশোরী, স্কুলের পড়ুয়া। অভিযোগ সরকারি বাহিনী ওই ১৮ জনকে গণধর্ষণ করে। বাকিদের উপর চলে অত্যাচার। ভাঙচুর করে দেওয়া হয় ভাচাথির বাসিন্দাদের বাড়িঘর।
এর পরে ভাচাথির গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে চোরাচালান, চুরি, ডাকাতির মামলা দেওয়া হয়। নির্যাতিতারা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গেলেও নেওয়া হয়নি। নিম্ন আদালতে মামলা চলাকালীন একাধিক নির্যাতিতা গণধর্ষণের কথা বিচারককে জানালেও বিচারকেরা বলেছিলেন, 'সরকারি অফিসারেরা আবার ধর্ষণ করে নাকি?'
কীভাবে ফের মামলা?
গ্রামবাসীরা কারাবাস শেষে গ্রামে ফিরে একজোট হয়েছিলেন। ন্যায্য বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। সেই সময় তাঁদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কয়েকটি মানবাধিকার গোষ্ঠী। সিপিআইএম দলের কর্মী আইনজীবীরা নির্যাতিতদের হয়ে মামলা দায়ের করেন। পাশাপাশি চলে আন্দোলনও। চাপ বাড়ে রাজ্য সরকারের উপর। ফলে তামিলনাড়ু সরকার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তে গ্রামবাসীদের অভিযোগের সত্যিতা স্পষ্ট হয়।
নিম্ন আদালতের নির্দেশ-
নিম্ন আদালত ২০১১ সালে ২৬৯ জন পুলিশ, বনরক্ষী ও প্রশাসনিক অফিসারকে তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের উপরে অত্যাচারে দোষী সাব্যস্ত করে। এরপর থেকে বিচার চলাকালীন ৫৪ জন দোষীর মৃত্যু হয়। বাকি ২১৫ জনকে ১ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এদের মধ্যে গণধর্ষণের জন্য ১৭ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু ওই ১৭ জন দোষীই নিম্ন আদালতের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টে মামলা করে।
মাদ্রাজ হাইকোর্টের কী নির্দেশ?
নিম্ন আদালতের নির্দেশ বহাল রেখে মাদ্রাজ হাইকোর্ট শুক্রবার নির্দেশ দেয় যে, অবিলম্বে সমস্ত দোষীদের সাজার বাকি মেয়াদ নিশ্চিত করতে হবে।
বিচারপতি ভেলমুরুগান তামিলনাড়ু সরকারকে ২০১৬ সালে ডিভিশন বেঞ্চের আদেশ কার্যকরে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ অনুসারে প্রত্যেক ধর্ষিতাকে অবিলম্বে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং দোষীরা সেই অর্থের ৫০ শতাংশ দেবে।
আদালত অভিযুক্তদের রক্ষা করার জন্য তৎকালীন জেলা কালেক্টর, পুলিশ সুপার এবং জেলা বন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছে।