মাদ্রাসার হাল খারাপ। ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, নমাজ পড়া যাচ্ছে না... মাদ্রাসার হাতে এরকম টাকাও নেই যা দিয়ে ছাত্রদের শীতকালের জন্য কাঁথা বা কম্বল কিনে দেওয়া যায়। ৬০ জনকে খাওয়ানোর টাকাও মাদ্রাসার হাতে নেই। এদের দ্রুত সাহায্য দরকার।
সাম্প্রতিকতম বই Madrasas in the Age of Islamophobia শুরু হচ্ছে এক মাদ্রাসার জন্য অর্থসংগ্রহকারীর এমনই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে, যে ছবি হিন্দি বলয়ের যে কোনও ইসলামিক পাঠচর্চা কেন্দ্রের বাস্তবতাও বটে।
সেজ কর্তৃক প্রকাশিত, বিশিষ্ট সাহিত্য ও সমাজবিষয়ক ভাষ্যকার জিয়া উস সালাম এবং বিজ্ঞান লেখক মহম্মদ আসলাম পারভেজ লিখিত এ বইয়ে মাদ্রাসার অবক্ষয়ের কথা রয়েছে, রয়েছে অতীতের উৎকর্ষ ও শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে এই কেন্দ্রগুলি কীভাবে পরিচালিত হতো, সে কথাও। এখন এই মাদ্রাসাগুলিকে দেখা হয় সেকেলে গোঁড়া পাঠশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে, বা দেখানো হয় উগ্রপন্থার আখড়া হিসেবে, ভুলে যাওয়া হয় কীভাবে এই মাদ্রাসাগুলি ভারতের ইতিহাসে মহিমামণ্ডিত ভূমিকা পালন করেছে।
সমাজসংস্কারক রামমোহন রায়, লেখক মুন্সী প্রেমচাঁদ, এবং ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ শিক্ষালাভ করেছিলেন দেশের সেরা মাদ্রাসা থেকে। মোগল সাম্রাজ্য থেকে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের ইতিহাসে মাদ্রাসাগুলি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে গিয়েছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ডট কমকে দেওয়া এক টেলিফোনিক সাক্ষাৎকারে এই বইয়ের দুই লেখক সালাম ও পারভেজ মাদ্রাসার বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ সমাধান নিয়ে আলোকপাত করেছেন। সাক্ষাৎকারের সারাংশ নিম্নরূপ-
মাদ্রাসার মর্মান্তিক বর্ণনা দিয়ে শুরু করলেন কেন?
আপনি যদি একটা সাধারণ মাদ্রাসায় যান, তাহলে এই বঞ্চনা ও বৈষম্যের ছবিই দেখতে পাবেন। দিল্লির বাহাদুর শাহ জাফর মার্গে মাদ্রাসা রশিদিয়া পরিদর্শনের পর এই বর্ণনা দিয়ে শুরু করার কথা স্থির করি। ৮ থেকে ১৬ বছরের ৫০টা ছেলে ওখানে রয়েছে, যাদের একটা ডরমিটরি পর্যন্ত নেই। শীতে বা গ্রীষ্মে ছেলেগুলো করিডোরে ঘুমোয়। এদের পড়াশোনার কোনও নির্দিষ্ট সিলেবাস নেই। এদের কেবল কোরান মুখস্থ করতে বলা হয়।
মাদ্রাসায় সামাজিক সমাবেশ, পিকনিক, মাঠে বা সিনেমা হলে যাওয়ার কোনও ভাবনাও নেই। প্রায় সমস্ত ছাত্ররাই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী এবং এতই হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে যে তাদের দিনে দুবেলা খাওয়া জোটে না। ফলে তাদের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা দিনের শেষে দুটো খেতে পায় আর কোরান পড়তে শেখে। কোরান যে শুধু পড়ার নয়, বোঝারও, সে কথা এঁরা ভাবেন না।
শিক্ষকদের কথা যদি বলেন, তাঁদের মাথাতেও এ বিষয়টা আসে না কারণ তাঁরাও একই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে এসেছেন। এই প্রেক্ষিতেই বই লেখার কথা মাথায় আসে।
সর্বদাই কি এরকম ছিল?
একটা সময় ছিল যখন মাদ্রাসা থেকে সেরা চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদ, গণিতবিদরা আসতেন। সেখানে ইতিহাস, ভূগোল, অন্য ভাষা ও কবিতা পড়ানো হতো। মাদ্রাসা তাদের স্বর্ণযুগ বিস্মৃত হয়েছে। এখন সেখানে কেবল প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী যায়।
পরিস্থিতি বদলাল কীভাবে?
উনিশ শতকের গোড়ায় পরিস্থিতি বদলাতে থাকে, কিন্তু স্বাধীনতার পরে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটে। ১৮৩৫ সালে মেকলে যখন শিক্ষানীতি প্রকাশ করেন, তখন ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার মধ্যে ফারাক করা হয়েছিল, যা ছিল মাদ্রাসার ধারণার পক্ষে চরম সর্বনাশা। অমুসলিম যেসব ছাত্ররা কোরান পড়তে চাইত না, মাদ্রাসায় তারা বেদ পড়ত, হিন্দু পুরাণ পড়ত। কিন্তু মেকলে চেয়েছিলেন এমন একটা প্রজন্ম তৈরি করতে যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ সুশিক্ষিত মুসলিমরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানবে না, এবং ধর্মজ্ঞরা নিজের ধর্মের বাইরে আর কিছু জানবে না। ইসলামি শিক্ষন পদ্ধতিকে দুর্বল করার এ ভাবনা বহু চিন্তা করেই করা হয়েছিল। ভারতের আধুনিক মাদ্রাসাগুলিও আজও সেই ধারাই বহন করে চলেছে।
উত্তর ভারতের মাদ্রাসাগুলি প্রায় সবই এইরকম। দক্ষিণ ভারতে পরিস্থিতিটা একটু আলাদা। তামিলনাড়ু ও কেরালায় কোনও কোনও মাদ্রাসার সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিট্যিুটের যোগ রয়েছে, যেখানে মাদ্রাসায় সকালে কোরান শিক্ষার পর বিকেলে বা সন্ধেয় ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা নিতে যাওয়া যায়।
মোগল যুগে ও সুলতানি আমলে মাদ্রাসার ভূমিকা কী ছিল?
সুলতানি আমলে প্রত্যেকে ছিল শিক্ষার্থী। যাঁরা অর্থবান ছিলেন, তাঁরা ভৃত্যদেরও শিক্ষায় উৎসাহ দিতেন। সেসব ক্রীতদাসরা শুধু কোরানই ভালভাবে জানতেন তা নয়, অনেকেই গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কেও পারদর্শী ছিলেন। বিশেষ করে ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময়ে শিক্ষা চূড়ান্ত জায়গা নেয়, দিল্লি শহরে এক হাজার মাদ্রাসা ছিল সে সময়ে।
মোগলদের সময়েও সম্রাট আকবর চেয়েছিলেন মাদ্রাসায় আরও কিছু ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় যুক্ত করা হোক। কার্যত মোগলদের সময় থেকেই শিক্ষাই হয়ে ওঠে রাজকর্মচারী হওয়ার সহজ পন্থা, সে ধর্ম যাই হোক না কেন।
স্বাধীনতার যুদ্ধে মাদ্রাসার ভূমিকা কী?
১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের সময় থেকে ১৯৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত মাদ্রাসা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়ে এসেছে। ১৮৫৭-র বিদ্রোহের সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মৌলবি ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত বেশ কয়েকটি উলেমা গোষ্ঠী ছিল, যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিহার ও আওয়াধের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল। ১৯ মে, ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ শুরুর পর ব্রিটিশরা মুসলিমদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এ সময়ে মুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় বুঝতে পারে। তারা বুঝতে পারে যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে শিক্ষা। সেজন্য তারা দেওবন্দ স্কুল চালু করে, ১৮৬৬ সালে যা ছিল পশ্চিম এশিয়া সহ সমগ্র এশিয়ার বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেওবন্দ থেকে ১৯১৯ সালে তৈরি হয় জমিয়ত-উলেমা-ই-হিন্দ এবং তারা খিলাফৎ ও অসহযোগ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। পরে তারা ১৯৪২-এর অগাস্টে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
বর্তমান সময়ে মাদ্রাসার তাৎপর্য কী?
মাদ্রাসার যে ইতিবাচক দিক আলোচনাতেই আসে না, তা হলো, যাদের কাছে শিক্ষার অন্য কোনও মাধ্যম নেই, তাদের সাক্ষর করে তোলা। এমনকি আজকের পশ্চিমবঙ্গেও অমুসলিমরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে।
অনেক সমস্যা থাকলেও মাদ্রাসাগুলি প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৯০ শতাংশের বেশি মাদ্রাসা ছাত্র আসে অতি গরিব পরিবার থেকে। মাদ্রাসায় তারা পড়তে ও লিখতে শেখে এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার মত ন্যূনতম শিক্ষা সেখানে তাদের দেওয়া হয়ে থাকে।
আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে মাদ্রাসাগুলির কীভাবে নিজেদের পরিবর্তিত করা উচিত বলে মনে হয়?
পবিত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ, এ দুয়ের মধ্যে তাদের সমন্বয় করতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকে পিছনে ফেলে দিলে চলবে না। ছাত্রদের শুরু থেকে ইংরেজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান শেখাতে হবে। একটা চেষ্টা চালাতে হবে, যাতে মাদ্রাসা থেকে বেরোনোর পর একজন ছাত্র যেন শুধু ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়, সে যেন তিন তালাক বা নিকাহ হালালা নিয়ে বিতর্ক করতে পারে। একই সঙ্গে সে যেন সরকারি বা বেসরকারি দফতরে চাকরির যোগ্য হয়ে ওঠে।
আইসিএসই বা সিবিএসই-র অ্যাফিলিয়েশন এ ব্যাপারে সঠিক দিশা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে মাদ্রাসাগুলিকে কেবল কোরান ও হাদিথ শিক্ষার বাইরে অন্য শিক্ষাতেও মনোযোগী হতে হবে।
এ ছাড়া এদের শিক্ষন পদ্ধতিও খুবই প্রাচীন। এই লকডাউনের সময়ে প্রায় সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন অনলাইনে পড়াশোনা চালাচ্ছে, তখন মাদ্রাসার কাছে এ পদ্ধতি কেউ প্রত্যাশাই করছে না। তার একটা কারণ অবশ্যই ছাত্ররা অতি দরিদ্র, ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন তাদের নেই। কিন্তু অন্য দিক থেকে দেখলেও মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থা একটা সময়ের গণ্ডিতে আটকে পড়েছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন