অবশেষে প্রকাশিত হল আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি) অথবা জাতীয় নাগরিক পঞ্জী। দেশজুড়ে এই এনআরসি তালিকা নিয়ে এতদিন ছিল তুমুল জল্পনা। কিন্তু এই নাগরিকপঞ্জী তৈরির আবেদনের নেপথ্যে যিনি, তাঁর নাম আমরা অনেকেই জানি না। আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে একাকী জীবন যাপন করা অশীতিপর প্রদীপ কুমার ভুঁইয়ার আবেদনের পরই নাগরিকপঞ্জী নিয়ে নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় সরকার।
১৯৫৮ সালে পাশ করা আইআইটি খড়গপুরের এই প্রাক্তনী অবশ্য নিজেকে কোনওভাবেই সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করতে চান নি। প্রাথমিকভাবে সাক্ষাৎকার দিতেও অস্বীকার করেন। তবে আসামের বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন, যতই নেপথ্যে থাকুন না কেন, রাজ্যের দীর্ঘদিন ধরে 'পড়ে থাকা' এই দাবিকে কেন্দ্রের সামনে তুলে ধরার পিছনে রয়েছেন প্রদীপ ভুঁইয়াই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রথমবার এনআরসি নিয়ে মুখ খুললেন চুরাশি বছরের এই বৃদ্ধ।
কীভাবে এই নাগরিকপঞ্জীর বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হলেন?
২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে অসম পাবলিক ওয়ার্কস নামক একটি এনজিও সংস্থা থেকে অভিজিৎ শর্মা একটি আবেদন নিয়ে আসেন। তিনিই আমাকে বলেন যে অসমের প্রধান সমস্যা হলো অবৈধ অভিবাসন, এবং দীর্ঘদিন ধরে পড়েই আছে নাগরিক পঞ্জীর কাজ। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এনআরসি-র বাস্তবায়নের জন্য আমি কোনও আবেদনের খসড়া করতে পারি কিনা।
নাগরিক পঞ্জী তৈরি সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম। ঠিকই করেছিলাম, যদি এরকম কিছু করতেই হয় তবে তা ডেটা এবং পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই করতে হবে। আমাদের এটা দেখানোর প্রয়োজন ছিল, কীভাবে কয়েক বছর ধরে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভোটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি তাঁকে জানাই, এই কাজ করতে গেলে আমার নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ নথি চাই। পরের দু'মাস ধরে তা নিয়ে আমি কাজ করে গেছি। ১৯৭১ সাল থেকে আসামের প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রের ফলাফল থেকে সব তথ্য খুঁটিয়ে পড়তাম আমার অফিসে বসে।
২০০৯ সালের জুলাই মাসে একটি জনস্বার্থ মামলা করা হয়, এবং সুপ্রিম কোর্টে তা গ্রহণ করা হয়। অভিজিৎ চেম্বারের ভিতরে ছিল আর আমি বাইরে। আসলে বাইরে বসে বসে প্রার্থনা করছিলাম যাতে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে গ্রহণ করা হয়। কারণ সেই সময় সুপ্রিম কোর্টে প্রায় ৬০ শতাংশ জনস্বার্থ মামলাই গ্রহণ করা হচ্ছিল না।
অভিজিৎ এবং এপিডাব্লু পরবর্তীকালে এনআরসির অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন। আপনি কেন নেপথ্যে রইলেন?
আমার কাছে একজন এসেছিলেন একটি আবেদন নিয়ে, আমি সেই কাজটি করেছিলাম কারণ আমি মনে করেছিলাম যে এই কারনটি আমার নিজেরও। আমার সময়ে আসাম বিক্ষোভে আমিও সামিল হয়েছিলাম। তার পরেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে বিষয়টি সমাধান করা দুরূহ ব্যাপার, এবং রাজনৈতিক শক্তি অভিবাসীদের দিকেই যাচ্ছে। অবশ্যই আমিও চিন্তায় ছিলাম। সেই সময় আমি সেটাই করেছিলাম যেটার প্রয়োজন ছিল। আর আমি সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলি নি কারন সেটা আমার স্বভাব। আমি এই কাজ করেছি নিজের রাজ্যকে ভালোবেসেই।
এই মুহুর্তে সকলের চোখ অসমে এনআরসি-র দিকে। এনআরসি-র কারনে বহু মানুষকে হেনস্থা হতে হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষকে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে। আপনি কি এই ধরনের সংকটের কথা ভেবেছিলেন?
দেখুন, এই কাজটি এতটাই বিশাল, যে এটি মানুষকে প্রভাবিত করতে বাধ্য। এটির ১ শতাংশ তারতম্যে রাজ্যের তিন লক্ষ মানুষ প্রভাবিত হতে পারে, এতটাই ছিল এর বিশালত্ব। আমি কখনোই চাইনি, কাউকে নির্যাতন করা হোক। বিশেষত মহিলা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব নেওয়া ভারত সরকারেরই কর্তব্য। আমি জানি না কেন ১৯৮৫-র পর থেকে প্রতিটি সরকার এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করে গেছে।
আপনার কি এটাই মত যে অসমের এই দিকটিকে কখনই সর্বসমক্ষে নিয়ে আসা হয়নি, কিংবা অসমকে উপেক্ষিত করেই রাখা হয়েছিল?
আসামের অস্থিরতার যে কারণগুলি ছিল, সেগুলিকে স্বাধীনতার পর থেকেই ভুলভাবে নেওয়া হয়েছে, সুতরাং এটা নতুন কিছু নয়। আমরা আমাদের পয়েন্ট প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, সেই কারণেই এই এনআরসি। তবে গণমাধ্যম যেভাবে লিখছে ইস্যুটিকে নিয়ে, আমি তাদের দোষ দিচ্ছি না। এত মানুষ যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সেখানে বিষয়টির আন্তর্জাতিকরণ করাটাই স্বাভাবিক।
তাহলে এনআরসি দিয়ে কী অর্জন হতে পারে বলে আশাবাদী আপনি?
সরকার ইতিমধ্যে বলেছে যে যাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁরা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালেও আবেদন করতে পারেন। দেখুন, এনআরসির মাধ্যমে কখনওই কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়াটা উদ্দেশ্য নয়। তবে তাঁদের বিদেশী অথবা ভারতীয় হিসাবে ঘোষণা করা পর্যন্ত, আমি নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করব তারা যেন প্রথমে ভোটার লিস্ট থেকে তাঁদের নাম বাদ দেয়। কাজের অনুমতি অবশ্যই দিন, কিন্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম চলবে না। ভাষা, সংস্কৃতি বাদ দিয়ে যেভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ চলছিল, তা বন্ধ করাই প্রধান লক্ষ্য ছিল।
তবে অনেকেই, এমনকি অসম পাবলিক ওয়ার্কসের তরফ থেকেও বলা হয়েছিল, এটি একটি ভুল তালিকা যা তারা কখনই গ্রহণ করবে না। আপনিও কি ভেবেছিলেন যে আপনার পুরো পরিশ্রমটাই ব্যর্থ হয়েছে?
দেখুন, এটি একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এখানে মানুষের নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে। আমি এই এনআরসি প্রয়োগ নিয়ে কোনও কথা বলতে রাজি নই। কিন্তু এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সবাই মিস করে যাচ্ছি। ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় বহু বাংলাদেশী এদিকে আসেন, যাঁরা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে এনআরসি অ্যাপ্লাই করেন নি। যদিও সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে দশ লক্ষ মানুষ, কিন্তু ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল অবধি ভোটারের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে আমার বিশ্বাস, সেই সংখ্যা আরও বেশি। সরকারের উচিত সেইসব ছদ্মবেশী ভোটারদের চিহ্নিত করা। আমার কাছে এই এনআরসি হল বহুবছরের একটি সমস্যার সমাধান মাত্র।
Read the full story in English