করোনাভাইরাস অতিমারীর মোকাবিলায় রাষ্ট্রসংঘের আওতাধীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization বা WHO) ভূমিকা নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর সমালোচনার বুধবার কড়া প্রতিক্রিয়া দিলেন WHO-এর প্রধান। ট্রাম্প এও বলেছিলেন যে WHO-কে দেওয়া মার্কিন অর্থ সাহায্য পুনর্বিবেচনা করে দেখবে ওয়াশিংটন।
WHO-এর ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস বলেছেন, বিশ্বজোড়া এই স্বাস্থ্য সঙ্কটের মুহূর্তে একতার প্রয়োজন, পরিস্থিতির "রাজনীতিকরণ" নয়। তিনি বিশেষভাবে চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে "স্বচ্ছ নেতৃত্ব" দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন, এবং এও বলেছেন যে তিনি আশা করেন যে আমেরিকা অর্থ সাহায্য করে যাবে যেমন করে এসেছে, প্রথা মেনে দুই দলের সমর্থন সমেত।
বুধবারই ফের একবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমালোচনায় নামেন ট্রাম্প এবং তাঁর প্রশাসন। রাষ্ট্রসচিব মাইক পম্পেও বলেন যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আর্থিক সাহায্য করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে, যেহেতু কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা যদি মার্কিন করদাতাদের টাকা ব্যবহার করে, তবে তার সদ্ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা দেখা ওই সংস্থার কর্তব্য। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্ব বদলের প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাস- মৃত্যুহারই যখন প্রশ্নের মুখে
গত বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তহবিলে মার্কিন অবদান ছিল ৪০০ মিলিয়ন (৪০ কোটি) ডলারের বেশি, যা কিনা তালিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অর্থ প্রদানকারী দেশের প্রায় দ্বিগুণ, বলছে মার্কিন পরিসংখ্যান। WHO-এর ওয়েবসাইটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শীর্ষ দাতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা কিনা সংস্থার বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ অর্থ দান করে।
হোয়াইট হাউজে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত প্রাত্যহিক সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বেইজিং যা অর্থ দান করছে, তা আমেরিকার একটি খণ্ডাংশ মাত্র, যা "একেবারেই ন্যায়সঙ্গত নয়"। এর পর তিনি বলেন, "সুতরাং আমরা পরীক্ষা করব, তদন্ত করব। এবং ঠিক করব আমরা কী করছি। ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কিছু করছি না, আমরা...দেখতে চাই।"
ট্রাম্প আরও বলেন, গত ১৪ জানুয়ারি একটি বিবৃতি জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে যে "মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটছে না", এবং তিনি চিন থেকে আসা সমস্ত উড়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চাইলে "অত্যন্ত কড়া" ভাষায় তাঁর সমালোচনা করে।
টেড্রোস পাল্টা বলেন যে WHO "দুনিয়াকে যাবতীয় তথ্য, ডেটা এবং প্রমাণ দিয়ে এসেছে", এবং বলেন যে ৩১ ডিসেম্বর চিন প্রথম "অজ্ঞাত কারণে নিউমোনিয়া"র বিষয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানানোর ১০০ দিন পূর্ণ হবে আজ, বৃহস্পতিবার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা "চিন-কেন্দ্রিক", ট্রাম্প-এর এই মন্তব্য খারিজ করে ইথিয়োপিয়ার প্রাক্তন মন্ত্রী টেড্রোস বলেন, "আমরা প্রত্যেক দেশের ঘনিষ্ঠ, আমরা বর্ণান্ধ।"
এর আগে টেড্রোস-এর উচ্চপদস্থ উপদেষ্টা ডাঃ ব্রুস এইলওয়ার্ড চিনের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্পর্কের সমর্থনে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে সঠিকভাবে বুঝতে গেলে বেইজিংয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। ফেব্রুয়ারি মাসে চিন সফরকারী বিশেষজ্ঞদের একটি দলের নেতৃত্ব দেওয়া এইলওয়ার্ড বলেন, "প্রাদুর্ভাবের প্রথম ধাপে যতটা সম্ভব তথ্য যোগাড় করা অত্যন্ত জরুরি ছিল, এবং এর চরিত্র বুঝতে উৎপত্তিস্থলে পৌঁছে চিনা প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করার।"
আরও পড়ুন: প্রবাসে, দৈবের বশে…করোনার পূর্ণগ্রাসে
ওদিকে একটি রেডিও চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন রাষ্ট্রসচিব পম্পেও বলেন, "আমার মনে হয় এটা এতদিনে স্পষ্ট যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিজেদের মূল্য বজায় রাখে নি, যা করার জন্য গঠিত হয়েছিল তা করতে পারে নি, এবং আমরা এটা আর চলতে দিতে পারি না। একটা উপায় বের করতেই হবে।"
তবে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত মিডিয়া সম্মেলনে যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় যে WHO-এর নেতৃত্ব বদলানোর সময় এসেছে কিনা, তিনি উত্তর দেন, "এই ধরনের পরিবর্তনের সময় নয় এটা।"
'আমরা ভুল করি'
নিউ ইয়র্কে বুধবার রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল আন্টনিও গুটেরেজ বলেন যে বিশ্বজুড়ে অতিমারীর বিরুদ্ধে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা পর্যালোচনা করার সময় এখন নয়, বরং বিশ্বের উচিত একজোট হয়ে ভাইরাসের প্রতিরোধ করা।
টেড্রোস বলেন যে বর্তমান জরুরি অবস্থা কেটে গেলে তাঁর সংস্থা নিজেদের কাজের যথারীতি মূল্যায়ন করে তা থেকে নিজেদের শক্তি এবং দুর্বলতা সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করবে, এবং যোগ করেন, "অন্যান্য মানুষের মতোই আমরাও ভুল করি।"
নিজের উপদেশের সারমর্ম হিসেবে তিনি বলেন, "দয়া করে রাষ্ট্রীয় স্তরে একতা বজায় রাখুন, COVID-কে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করবেন না। দুই, বৈশ্বিক স্তরে সংহতি দেখান। এবং আমেরিকা এবং চিনের কাছ থেকে স্বচ্ছ নেতৃত্ব আসুক।" তিনি আরও বলেন, "সবচেয়ে শক্তিশালীদের উচিত এ সময় পথ দেখানো, এবং COVID রাজনীতিকে কোয়ারান্টাইনে পাঠিয়ে দেওয়া।"
টেড্রোস-এর আরও বক্তব্য, বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের উচিত, ১৯৬৭ সালে স্মলপক্স-এর মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনয়নের যৌথ পদক্ষেপের উদাহরণ অনুসরণ করা। সেসময় এক দশকের একটি অভিযান চালায় বিশ্ব রাজনীতির এই দুই চিরশত্রু, যার ফলে চিরকালের মতো নির্মূল হয়ে যায় স্মলপক্স, যার বার্ষিক বলি হতেন দুনিয়ার প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ।
তাঁর বিরুদ্ধে "বর্ণবিদ্বেষ ভিত্তিক কুমন্তব্য" উড়িয়ে দিয়ে টেড্রোস বলেন, এগুলির উৎস তাইওয়ান, এবং আরও বলেন যে এই সঙ্কট চলাকালীন প্রাণনাশের হুমকিও পেয়েছেন তিনি। "রোজ এতগুলি প্রাণ যাচ্ছে, এসময় আমাকে কী বলা হলো না হলো তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাব কেন?" তাঁর কথায়, পৃথিবীতে আপাতত ১৩ লক্ষ সংক্রমণের ফলে "৬০ হাজার বডি ব্যাগ"-এর প্রয়োজন পড়েছে। "আমরা যদি সঠিক আচরণ না করি, আমাদের সামনে আরও অনেক বডি ব্যাগ পড়ে থাকবে," বলেন তিনি।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন