ভূস্বর্গ কাশ্মীর। কিন্তু, সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর উপত্যকাজুড়ে এখন ভয় ও উদ্বেগের পরিবেশ, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে। কাজে যাওয়া তো দূরঅস্ত। হিন্দু, শিখ সরকারি কর্মী থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকা- কাশ্মীর ছেড়ে প্রাণভয়ে কোনওমতে এখন তাঁরা পালাচ্ছেন জম্মুতে। এর জন্য নিরাপত্তার অভাবকেই দায়ী করেছেন সেখানকার সংখ্যালঘুরা।
সুশীল, শ্রীনগরে শিক্ষা দফতরের জুনিয়র অ্যাসিসটেন্ট পদে কর্মরত সরকারি কর্মচারী। প্রাণভয়ে তিনি ইতিমধ্যেই কাশ্মীর ছেড়ে জম্মুতে ফিরেছেন। বলছেন, 'কাশ্মীর থেকে আমি বাইকে প্রানভয়ে পালিয়েছি।'
সম্প্রতি, কাশ্মীরে এক শিখ মহিলা অধ্যক্ষ ও একজন হিন্দু শিক্ষককে নিশানা করে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনায় উপত্যাকাজুড়ে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। জীবন নিরাপদ মনে করছেন না সেখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘুরা। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সুশীল বলেছেন, 'কাশ্মীরে রাস্তায় চলার সময় সবসময় একটাই কথা মনে হয়, কেই যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, হয়তো এখনই গুলি করবে।' অর্থাৎ ভয় ও অবিশ্বাসের বাতাবরণ যে কত গভীরে তা সহজেই অনুমেয়।
কাশ্মীরের সংখ্যালঘু হিন্দু ও শিখদের নিরাপত্তা এখন প্রতিপদে প্রশ্নের মুখোমুখি। ১৯৯০ সালে পণ্ডিতদের উপর নিপীড়নের সময় মাতৃভূমি ছেড়েছিলেন সিদ্ধার্থ রায়নার (নাম পরিবর্তিত) পরিবার। কিন্তু, পিতৃপুরুষের জায়গার প্রতি টান কাটেনি। তাই সুযোগ পেতেই প্রায় দু'দশক পর ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দফতরের চাকরি নিয়ে কাশ্মীরের ফিরেছিলেন সিদ্ধার্থ। শুক্রবার তিনিও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অনন্তনাগ ছেড়েছেন। বিনিদ্র ও ভয়ের সেই রাত মনে করেই এখনও শিউরে উঠছেন তাঁরা। বলছেন, 'ওই দিন ঘটনার পর আমি সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারিনি। পরের দিনই কাশ্মীর ছেড়েছি। সম্প্রীতি ও শান্তির পরিবেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এখনও নিরাপত্তার কোনও নিশ্চয়তা সরকার দেয়নি। যদি আততায়ীরা শিক্ষকদের পরিচয় জেনেও তাঁদের খুন করেন, তবে আমার মতো সরকারী কর্মী কাশ্মীরি পণ্ডিতদের প্রাণের নিশ্চয়তা কে দেবে? '
তবে সুশীল জানাচ্ছেন যে, তাঁর মুসলিম সহকর্মীরা ভালো, সহযোগিতাও করেছেন। কিন্তু সংখ্যালঘু সরকারি কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়টি সরকারের আরও ভালো করে বিবেচনা করা প্রয়োজন। 'হিন্দু, শিখ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাশ্মীরের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় নিয়োগ করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের জম্মুতে ফেরা ছাড়া আর কীই বা করার রয়েছে?'
ভয়ে সংখ্যালঘুদের কাশ্মীর ত্যাগের এই ছবি অবশ্য মানতে রাজি নয় স্থানীয় সরকার। জম্মু-কাশ্মীরের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার অশোক পণ্ডিতা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সরকারি কর্মীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে কাশ্মীরের ডিভিশনাল কমিশনারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকারি সবস্তরে এই কাজ করতে হবে।'
যদিও বাস্ত চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাগতি শহরের দোকানি রমেশ কুমারের কথায় তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, 'পিএঅম প্যাকেজের আওতায় কাশ্মীরে চাকরি করতে আসা বহু সরকারি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মী চলে গিয়েছেন। আমার অন্তত জনা তিরিশের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাঁরা প্রায় ২-৩ মাস পর দোকানে এলেন। তাঁরা জানিয়েছেন যে, প্রাণ ভয়ে কাশ্মীর ছেড়েছেন, এমনকী রাত ১২টার পরও বাড়ি ছাড়ছেন তারা। শক্তপোক্ত ব্যক্তিকেও আজ বেচারা মনে হচ্ছে।' রমেশ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে কথা বলার সময়ই আরও দু'টি পরিবার উপত্যকা থেকে জম্মুতে এসে পৌঁছায়। তবে তাঁরা কোনও কথা বলতে রাজি ছিল না। সরকারি চাপের জন্যই তাঁরা মুখ বন্ধ রেখেছেন বলে ধারণা এক প্রতিবেশীর।
১৯৯০-এর হিংসার পরও যেসব পণ্ডিত কাশ্মীর ছাড়েননি তাঁদের অনেকেই আবার দিন কয়েক আগেন নারকীয় ঘটনায় উদ্বেগে। তবে, তাঁরা অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণের নীতি ধারণ করেছেন। এরকমই একজন শ্রীনগরের আপমার্কেট এলাকার বাসিন্দা রহিত পণ্ডিত (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর কথায়, 'সবাই আমাকে খুন করার জন্য নিশানা করছে। তবে গুলি চালনোর ধরণ দেখে মনে হচ্ছে সেসময়ের মতো দুষ্কৃতীরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ৩৭০ ধারা বিলোপ ও বর্তমানে আফগানিস্তানের ঘটনার পর বহিরাগতদের আক্রমণ করা হচ্ছে।' অবিশ্বাসের কারণেই এই পরিস্থিতি, তবে সরকারের নীরবতা ভাবাচ্ছে পেশায় দোকানের মালিক রহিতকেও।
শ্রীনগরের শিখ ব্যবসায়ী কেএল সিং (নাম পরিবর্তীত) ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের বসবাস করতেন। তাঁর দাবি, এই প্রথম কোনও মহিলা শিখকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে খুন করা হল। বহ বছর পর আবারও তরম উদ্বেগ, আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে সংখ্যালঘু শিখদের মধ্যে। তাঁর দাবি, 'ওই অধ্যক্ষ মুসলিম মহিলাদের শিক্ষা বিস্তারে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেনম। তাঁকেও ওরা ছাড়ল না। তবে, এইসব বরদাস্ত করা হবে না।'
ভয় এতটাই গভীরে যে, কেএল সিং (গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটির সদস্য) জানাচ্ছিলেন যে, তাঁর নিজের শিক্ষিকা ভাগ্নি কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বদলির আর্জি জানিয়েছেন। বলেন, '১৫ অগস্ট তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ শুধু সংখ্যালঘু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নয়, কাশ্মীরের প্রত্যেক স্কুলকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকেই সংখ্যালঘুদের বেছে নেওয়া হয়। এই ভয়ের বাতাবরণ আমি গত কয়েক বছরে লক্ষ্য করিনি।' সিংয়ের আক্ষেপ যে, এই নারকীয় ঘটনার পরও কোনও মুসলিম সংগঠন প্রতিবাদ করেনি।
পিডিপি সংখ্যালধু সেলের সদস্য তথা উপত্যকার উল্লেখযোগ্য শিখ নেতাযোগিন্দার সিংয়ের কথায়, 'দুষ্কৃতীদের এই কাজে শিখরা ভয় পায়েনি। উল্টে আরও দৃঢ় হয়েছে। এই খুনের পর আমরা কাশ্মীর ছেড়ে পালাবো না। স্বাধীনতার সময় ৩৩ হাজার শিখ আত্মবলিদান দিয়েছেন। আমরা তাঁদের উত্তরসূরি, দেশ রক্ষা করবো।'
শিখ নেতা নভতেজ সিংয়ের কথায়, 'এই ঘটনায় আমরা হতবাক। কিন্তু দুঃখের যে, শেষ কৃত্যের জন্য যখন মহিলা অধ্যক্ষের দেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই সময়ও মুসলিম সংগঠনের কাউকে দেখা যায়নি। সরকারও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে কোনও দৃঢ় পদক্ষেপ করেনি।'
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন