মেডিক্যাল কলেজে অনশনের ২০০ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বেশ কয়েকজন অনশনরত ছাত্র, তবু তাঁরা দাবিতে অনড়। অধ্যক্ষ উচ্ছল ভদ্রের জায়গায় সাময়িক দায়িত্বে এসেছেন কার্যকরী অধ্যক্ষ ডাঃ রামানুজ সিনহা। মিটিং, মিছিল, অভিভাবক, প্রাক্তনদের প্রতীকী অনশন, হাউস স্টাফদের কর্মবিরতির মতো একাধিক অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে ডাক্তারি ছাত্রদের আন্দোলনে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গত ন'দিনে কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গন। কিন্তু এমন কী হয়ে গেল যে বিকল্প হস্টেল পেতে মরিয়া হয়ে উঠলেন পড়ুয়ারা? চলুন একবার ঘুরে আসা যাক সেই ছাত্রাবাস, যা এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।
মেডিক্যাল কলেজ চত্বরের পাঁচ নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে কয়েক পা হাঁটলেই সেই হস্টেল। প্রথমে ময়লা ফেলার ভ্যাট ভাবলেও ভুল ভাঙবে বিল্ডিং-এর সাইনবোর্ড দেখে। ইংরেজি হরফে লেখা মেডিকেল কলেজ বয়েজ হস্টেল (মেইন)। যা এতক্ষণ জঞ্জাল ফেলার জায়গা মনে হচ্ছিল, সেটা আসলে পুরনো হস্টেল ভবনে ঢোকার গেট, যেটা ছেড়ে পালাতে চাইছেন হবু ডাক্তাররা।
কেন এমন অবস্থা জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে হস্টেলের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তি জানালেন, গত দু'বছর পরিস্কার করা হয়নি এই জঞ্জাল। পরিস্কার করাতে হলেও নিতে হয় লম্বা উদ্যোগ। কারণ এই কাজের জন্য বরাদ্দ কোনও কর্মী নেই। প্রথমে প্রশাসনকে জানাতে হয়। এরপর প্রশাসন পৌরসভাকে অনুরোধ করলে পৌরসভা তার সময় মতো একশো দিনের কাজের লোক পাঠায়। তবে তাতেও বছর ঘুরে যাওয়ার জোগাড় হয়। তাঁর অভিযোগ, বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঝাড়ুদার একজনই। তিনি সপ্তাহে দু'বার আসেন এক ঘণ্টার জন্য।
হস্টেল আবাসিক নয়নের কথায়, "মশার উপদ্রবে টেকা যায় না, গত বছর আর এই বছর মিলিয়ে ২০ জনেরও বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ইতিমধ্যেই। আমরাই মাঝে মাঝে টাকা দিয়ে লোক নিয়ে এসে পরিস্কার করাই।" কথা শেষ করে দু'পা এগোতেই দেখা গেল একটা ঘরে লেখা গেস্ট রুম, তাতে গেস্টের জন্য রাখা রয়েছে একটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন সোফা।
কথা বলতে বলতে হস্টেলেরই এক কর্মী আঙুল দেখিয়ে বললেন, "ঐ যে হস্টেলের ওই দিকটা দেখছেন? এক হাঁটু জল জমে বর্ষায়, বৃষ্টির জলের সঙ্গে ওপরের শৌচাগারের জল এসে জমে। খুবই খারাপ অবস্থা।" একটু এগিয়ে গিয়ে আরও দেখালেন হস্টেলের পিছনের ভাঙা লোহার দরজাটা বন্ধ করা যায় না, জঞ্জাল জমে জমে দুর্গন্ধ বেরোয়, সঙ্গে মশার উৎপাত তো আছেই। এরপর খোলা ড্রেন, ভনভন মাছি, ভেঙে পড়া সিলিং, সব মিলিয়ে হস্টেলের কঙ্কালসার চেহারা ভয়াবহ রকম প্রকট।
আরও পড়ুন: ‘‘মেডিক্যালে অনশনরত কেউ মারা গেলে ফুলমালা’’, দুঃখপ্রকাশ বিভাগীয় প্রধানের
এ তো গেল একতলার ছবি। ওপরে উঠতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তা নিচের তলারই প্রতিফলন। বেশ কিছু চৌকি পড়ে রয়েছে করিডোরে। নয়নের কথায়, "ছারপোকারাই ঘুমায় ওখানে, বহুবছর ধরে ওরা ওখানেই থাকে। আমরা অনেকেই নতুন খাট কিনে নিয়েছি, কেউ কেউ কোনওমতে মানিয়ে নিয়েছে।" এরপর চোখ গেল হলুদ কয়েকটা বেসিনের দিকেও।
তারপরেই মিলল বহু বিতর্কিত সেই সিলিং ভেঙে পড়া ঘরগুলি। চোখে পড়ল টিনের চালের নীচে পি ডব্লু ডি-র সাময়িকভাবে বানিয়ে দেওয়া সেই ফলস সিলিংও। প্লাস্টিক দিয়ে কোনও মতে বৃষ্টির জল আটকোনোর চেষ্টা করা হয়েছে। হস্টেলের এক ছাত্রের কথায়, সারানোর সময় পি ডব্লু ডি-র লোক বলেই গিয়েছিলেন, দু'বছরের বেশি এই ফলস সিলিং থাকবে না।
ছাত্রদের অভিযোগ, হস্টেল সুপার সৌগত ঘোষ এমুখো হননি বহুদিন। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষও পুরনো হস্টেল পরিষ্কারের কোনও উদ্যোগ নেন না। প্রয়োজনে ছাত্ররা সরাসরি শরণাপন্ন হন পি-ডব্লু-ডির। তারা এসে ফের ঠেকা দিয়ে যায়।
এ তো গেল হস্টেল চত্বরের ছবি। হস্টেলের এক রক্ষীর কথায়, গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁদের দেদার ছুঁড়ে ফেলা ময়লা এসে জড়ো হয় হস্টেলের আশেপাশেই। ফলাফল দুর্গন্ধ, ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার আতঙ্ক। অভিযোগ, একাধিক বার বলার পরেও কোনও রফাসূত্র মেলেনি। যদিও হুমকী মিলেছে কয়েকবার। আর এভাবেই ওই জঞ্জালের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই জমেছে ছাত্রদের অভিযোগের পাহাড়। "আদৌ সুরাহা মিলবে কিনা" এই বাক্যের পরও রয়ে গিয়েছে হাজার প্রশ্নবোধক চিহ্ন।