উল্টোডাঙ্গা বা বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভাঙার পরও যে প্রশাসনের টনক নড়েনি, তা মাঝেরহাট এবং শিলিগুড়ি সেতু ভেঙে পড়ায় আরেকবার প্রমান হলো। অবধারিতভাবেই রাজ্যের ব্রিজগুলির দেখভাল নিয়ে নানা মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। নিয়মিত সেতু বা উড়ালপুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। পাশাপাশি, মাত্র ছমাস আগে ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া মাঝেরহাট সেতু যেভাবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল, তাতে বিভিন্ন সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিয়মবিধি নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
এখন কথাটা হলো, যে পূর্ত দফতরের হাতে কিন্তু একটি মোবাইল ব্রিজ ইন্সপেকশন ইউনিট (M.B.I.U.) রয়েছে। এই যন্ত্রের নিয়মিত ব্যবহার দুর্ঘটনা এড়াতে সাহায্য করতে পারে বলে মনে করছেন প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী। পূর্ত দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, এই ইউনিটটি ঠিকমত ব্যবহার করতে পারলেই ব্রিজ পরীক্ষার সমস্যা বহুলাংশে সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ইউনিটটি সেভাবে কাজে লাগানো হয় না। রাজ্যে এই একটিই ইউনিট, কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও তা বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করে ব্যবহার করা হয় না।
ওই ইঞ্জিনিয়ার জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক পরিবহণ ও হাইওয়ে মন্ত্রকের কাছ থেকে পাওয়া যায় ২০০৭ সালে জার্মানীতে তৈরি তৎকালীন চার কোটি টাকা দামের এই মোবাইল ব্রিজ ইন্সপেকশন ইউনিট (M.B.I.U.)। রাজ্যের সেতু ও উড়ালপুলের স্বাস্থ্যের পর্যবেক্ষণের জন্য এই যন্ত্রটি দেয় কেন্দ্র। মেশিনটি পূর্ত (সড়ক) মেক্যানিকেল বাগুইআটির গুদাম ঘরে রয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে এটি নিয়মিত রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সেতু ও উড়ালপুল পরিদর্শনে বের করা হত।
জানা গিয়েছে, মেক্যানিকালের সুপারিন্টেন্ড ইঞ্জিনিয়ার রুটিন করে রাজ্যের বিভিন্ন বিভাগের মুখ্য বাস্তুকার (chief engineer) ও অধিক্ষক বাস্তুকারদের (superintending engineer) সঙ্গে সমন্বয় করে চেকিং-এ পাঠাতেন। সঙ্গে সেতু বিশেষজ্ঞরা থাকতেন। এই দফতরের একাংশের অভিযোগ, পরিস্থিতি বদলাতে থাকে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে। অভিযোগ ওঠে, বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয় একরকম বন্ধ হয়ে যায়। একইসঙ্গে এমবিআইইউ নিয়মিত বেরনোও বন্ধ হয়ে যায় কোনও অজ্ঞাত কারণে। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সাত দিনের জন্য উত্তরবঙ্গে ব্রিজ পরীক্ষা করার জন্য ওই যন্ত্রটি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন: ব্রিজ বিপর্যয়ের জেরে এবার পুজোয় বাড়তি যান যন্ত্রণা?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমবিআইইউ নিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে রাজ্যের সেতু ও উড়ালপুলের হাল জানা সহজ হত। ফলে পরিকাঠামো ঠিক রাখতে পদক্ষেপ নেওয়া যেত।
প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী বলেন, "এই এমবিআইইউ কল্যাণীর ঈশ্বর গুপ্ত সেতুতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। তারপর নিয়ম করে রাজ্যের সেতুগুলির পর্যবেক্ষণ করতে যন্ত্রটি ব্যবহার করা হত। যার ফলে সহজেই সেতু ও উড়ালপুলের স্বাস্থ্য নির্ণয় সম্ভব ছিল। পর্যবেক্ষণের সুপারিশ মেনে ব্যবস্থাও নেওয়া হত। আমার মন্ত্রীত্বকালে নিয়ম করে সারা বছর এই যন্ত্রের মাধ্যমে ব্রিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হত। যেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা সহজে সম্ভব নয়, সেখানেও এটা ব্যবহার করা যায়। বড় সেতুগুলোর পাশাপাশি কলকাতার উড়ালপুলগুলো এমবিআইইউ দিয়ে পরীক্ষা করাতেই পারত।"
পূর্ত দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, একটা-দুটো ছাড়া রাজ্যের অধিকাংশ ব্রিজের স্বাস্থ্য রিপোর্ট ২০১৪ সালের আগের। দু-একটি ব্রিজের ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছিল। ২০১৩ সালের পর থেকেই প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে পরীক্ষা। সংশ্লিষ্ট আধিকারিক কোনও উদ্যোগ নেন না বলে অভিযোগ। এদিক মেশিন বাগুইআটিতে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।
এই দফতরের সংশ্লিষ্ট এক আধিকারিক মনেই করতে পারছেন না শেষ কবে যন্ত্রটি সেতু পরীক্ষা করেছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্তা বলেন, কয়েক মাস আগে এটি ঈশ্বর গুপ্ত সেতুর কাজে গিয়েছিল। তারপর আর কোথাও যায়নি। রাজ্যের সব সেতু নিয়মিত পরীক্ষা হয় কী না তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি ওই কর্তা। অনেক ব্রিজের আশেপাশে নানা ধরনের কেবল থাকার জন্য কলকাতার ব্রিজ বা উড়ালপুলে এই যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা "একটু অসুবিধা হলেও অসম্ভব নয়" বলেই ওই ইঞ্জিনিয়ারের মত। তাহলে কলকাতার ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা হয়নি কেন?
বাগুইআটিতে পূর্ত দফতরের গোডাউনে গিয়ে দেখা গেল, বিশেষভাবে তৈরি বিশালকায় গ্যারেজে পড়ে রয়েছে এমবিআইইউ। সেখানকার কর্মীরা জানালেন, যন্ত্রটি চালু এবং প্রস্তুত। কিন্তু বেশিরভাগ সময় গ্যারেজেই পড়ে থাকে। মাঝেরহাট সেতু ভাঙার পর এবার হয়তো মনে পড়তে পারে এমবিআইইউ-এর কথা। এর আগে উল্টোডাঙ্গা এবং বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে পড়ে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তবুও টনক নড়েনি পূর্ত দফতরের।
দফতরের একাংশের বক্তব্য, শুধু কো-অর্ডিনেশন করে কাজ করতে হবে, সেই কারণে যন্ত্রটি ফেলে রাখা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্যে সেতু ভেঙে আর কত মানুষের মৃত্যু হলে পূর্ত দফতরের গ্যারেজ থেকে নিয়মিত বেরবে এমবিআইইউ? এই বিষয়ে রাজ্যের বর্তমান পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা হলেও তাঁর বক্তব্য মেলেনি।