ভারতের ইতিহাসে বিরতম ট্রেন দুর্ঘটনা। শুক্রবার সন্ধ্যা কথা মনে পড়লেই শিউড়ে উঠছেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত দুই ট্রেনের বরাত জোরে বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা। নিয়তির পরিহাস কাকে বলে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বাবা বা মা কোনওক্রমে রক্ষা পেলেও শেষ হয়ে গিয়েছে তাঁদের সন্তানরা। নিজে বেঁচেও এখন সেই সব বাবা মায়ের সব হারানোর বুক ফাটা যন্ত্রণা। এঁদেরই অন্যতম বছর ৪০য়ের মহিলা লালজি সাগাই। বর্তমানে তাঁর বড় ছেলের ঠাঁই হয়েছে সোরোর হাসপাতালের মর্গে। আর মা লালজি সাগাই হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন হাসপাতালে।
বিহারের মধুবনীর বাসিন্দা লালজি সাগাই যখন দুই দিন আগে দুই ছেলেকে নিয়ে চেন্নাইয়ের উদ্দেশে বাড়ি ছেড়েছিলেন, তখন তাঁদের চোখে এররাশ স্বপ্ন। উন্নত জীবনের আশা নিয়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি জমানো।
পেশায় রক্ষী লালজি ভেবেছিলেন তাঁর মতই কাজ করবে দুই সন্তান। কিন্তু নিয়তির লিখন অন্য ছিল।
চেন্নাইগামী দুর্ঘটনাগ্রস্ত করোমন্ডেল এক্সপ্রেসের সাধারণ কোচের যাত্রী ছিলেন মা ও দুই ছেলে। শুক্রবারের দুর্ঘটনায় দুর্ঘটনায় সাগাইয়ের বড় ছেলে সুন্দরের মৃত্যু হয়। তবে ছোট ছেলে ইন্দর বেঁচে গিয়েছেন। নিহত সাইগাইয়ের শ্যালক দিলীপ।
আরও পড়ুন- মাকে দেওয়া কথা আর রাখা গেল না, তার আগেই ট্রেন দুর্ঘটনার বলি এ রাজ্যের বছর ১৮-র ছোট্টু
বালেশ্বরের সোরোতে কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে নিজের ছেলের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে লালজি সাগাই দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, 'আমরা ৯ জনের একটি দল চেন্নাই যাচ্ছিলাম। আমি সেখানে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কাজ করি। ডাবল ডিউটি করার পর প্রতি মাসে প্রায় ১৭ হাজার টাকা আয় করি। যেহেতু আমাদের গ্রামে কোনও কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই, তাই আমি আমাদের পরিবারের জন্য অতিরিক্ত আয় নিশ্চিত করতে আমার দুই ছেলেকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু নিয়তি আমাদের জন্য অন্য কিছু পরিকল্পনা করেছিল, যা আমি দুঃস্বপ্নেও অনুমান করতে পারিনি।'
সাগাই যখন কথা বলছে যন্ত্রণায় গলা বুজে আসছিল। তাও এক দৃষ্টতে বুক ফাটা কান্না আটকে বছর চল্লিশের মা বলতে থাকেন, 'দুর্ঘটনায় আমার ছেলে ও শ্যালক মারা গিয়েছে। নিজের হাতে ছেলের লাশ সরিয়ে এসেছি। খরচ যাই হোক না কেন, আমি ছেলের দেহ নিয়ে আমাদের গ্রামে ফিরতে চাই।'
আরও পড়ুন- ভয়াবহ-ভয়ঙ্কর! দুর্ঘটনার মুহূর্ত বলতে গিয়ে শিউরে উঠছেন কপালজোরে বেঁচে ফেরা যাত্রীরা
লালজি সাগাইয়ের মতো ভাগ্যজোরে বেঁচে থাকা অনেক ব্যক্তিই, যাঁরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সুযোগের জন্য বালেশ্বরের বিভিন্ন হাসপাতালে অপেক্ষমান, দুর্ঘটনার ভয়াবহ দৃশ্যগুলি বর্ণনা করার সময় তাঁরা শিউরে উঠছিলেন।
হাওড়ার তাপসী সর্দার (২২) পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে ১১ জনের একটি দলের অংশ ছিলেন। এঁরা অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুরে প্রায় সাত মাস কৃষি শ্রমিক হিসাবে কাটিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁরা যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসে ছিলেন। তাপসী নিজের স্টপেজ থেকে মাত্র চার ঘন্টা দূরে ছিলেন, কিন্তু তার মাঢেই ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বর্তমানে সোরো সিএইচসি-তে চিকিৎসাধীন সে। উপচে পড়া রোগীদের মধ্যে বলে তাপসী বলছিলেন, 'সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ছিল। আমাদের কোচ উল্টে যাওয়ার পর লোকজন চিৎকার করছিল। আমার মাথায় ও মুখে আঘাত লেগেছে, তবে আমি ভালো আছি। আমাদের গ্রুপের অন্যান্য সদস্যরাও ভালো আছেন। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি।'
আরও পড়ুন- করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা: কোন জিনিসটি থাকলে অ্যাক্সিডেন্টটাই হতো না? বলে দিলেন মমতা
ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলার গোপাল মিরধা (৪০) এবং তাঁর স্ত্রী অঞ্জু দেবীও যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসের সাধারণ কোচে ছিলেন। তাঁরা বেঙ্গালুরু থেকে ফিরছিলেন। দুই মাস আগে একটি নার্সারিতে কাজ করতে গিয়েছিল কিন্তু গোপালের মায়ের অসুস্থতার কারণে তাঁরা দেশে ফিরছিলেন। হাসপাতালে গোপাল বলিলেন, 'যেহেতু আমার মা ভালো নেই, আমরা তার যত্ন নেওয়ার জন্য বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এমনকি আমরা তাকে দুর্ঘটনার বিষয়ে অবহিত করিনি, কারণ সে টেনশনে থাকবে। আমি পায়ে এবং মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছি। আমাদের কোচের অনেক লোক ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছেন।'
পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা সুভাষ শেখ (৪৩) চেন্নাইগামী করোমণ্ডল এক্সপ্রেসের এস-১ কোচে ছিলেন। সেখান থেকে তিনি কেরালার পট্টম্বিতে যেতেন পাথরের কারখানায় কাজ করতে। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে আপাতত সুভাষের ঠিকানা সোরো সিএইচসি।