সৌরদীপ সামন্ত
২০১০ সালে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে মুক্তি পেল আরেকটি প্রেমের গল্প। বাইসেক্সুয়াল পুরুষের সঙ্গে ট্রান্সজেন্ডারের প্রেম নিয়ে বাংলার বড়পর্দায় এর আগে এমন সাহসী ছবি বাংলার দর্শক আগে দেখেছেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। কাট টু ২০১৬, ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখেছিলেন মা। আর তা জানতেই ছেলে, মা’কে জানিয়েছিল, ‘‘একজন ছেলেকে ভাল লাগে, ওর সঙ্গেই থাকতে চাই’’, নিজের সমকামী পরিচয় প্রথমবার মা-বোনের সঙ্গে এভাবেই শেয়ার করেছিলেন এ বছরের মিস্টার গে ইন্ডিয়া ও মিস্টার গে ওয়ার্ল্ডের সেকেন্ড রানার্স আপ সমর্পণ মাইতি। কিন্তু না, ছেলের সমকামিতা নিয়ে কোনও বকা-ঝকা করেননি তিনি। এ নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার কাছে সিদ্ধা এলাকায় সমর্পণের বাড়িতে কোনও অশান্তিও হয়নি।

এরপর কেটে গেছে দু’বছর। কার্যত তথাকথিত সমাজের চোখরাঙানি ফুৎকারে উড়িয়ে সটান বাংলার ছেলে পা রাখলেন মিস্টার গে ইন্ডিয়ার মঞ্চে। এর আগে অবশ্য এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন সমর্পণ। তারপর ইতিহাস। স্বপ্নপূরণের মতো মিস্টার গে ইন্ডিয়ার মঞ্চে সম্মান কুড়িয়ে নিলেন সমর্পণ। তারপর যেন সমর্পণের ইচ্ছাশক্তি, জেদ দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এরপর গন্তব্য ছিল সাউথ আফ্রিকা, যেখানে বসেছিল মিস্টার গে ওয়ার্ল্ডের আসর। সেখানে সেকেন্ড রানার্স আপ হয়ে বিশ্ব দরবারেও নিজেকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন সমর্পণ।

সমকামী প্রেম কি আদৌ টেঁকে? আদৌ কি কোনও কমিটমেন্ট থাকে? এ নিয়ে বাজারচলতি নানা কথা চালু রয়েছে। কিন্তু সমর্পণের চোখে ভালবাসা মানে ভালবাসাই। ভালবাসার যে কোনও লিঙ্গ হয় না, সে ব্যাপারে একমত সমর্পণ। আপাতত তিনি সিঙ্গল। কিন্তু সম্পর্কে যেতে চান সমর্পণ। তেমন এক পুরুষের খোঁজ যে তাঁর রয়েইছে, সে কথা গোপন করেননি তিনি। মুম্বই থেকে সমর্পণ বললেন, ‘‘ইচ্ছে তো রয়েইছে কারও সঙ্গে সেটল করার।’’

ভারতের মতো রক্ষণশীল দেশে সমকামিতা আইনত অপরাধ। তাও আবার বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের সমকামী পরিচয়, জানাজানি হলে তো, বিপদ! ভয় করে না সমাজ কী বলবে? ফোনের ওপার থেকে অবশ্য সমর্পণের অকাট্য জবাব, ‘‘আমি ছোটবেলা থেকেই চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসি।’’ এ নিয়ে আরও বললেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল, লোকেরা যেটা করতে সাহস পায় না, সেটাই করতে বেশি ইচ্ছে করে।’’ এ নিয়ে বলতে গিয়ে, হস্টেল লাইফের স্মৃতি আওড়ালেন ব্রেন ক্যানসারের গবেষক ছাত্র। বললেন, ‘‘হস্টেলে রাতে কেউ বেরোত না, আমি বেরোতাম, সেমেট্রিতে যেতাম।’’ চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রসঙ্গে অবশ্য বাবার কথা তুললেন সমর্পণ। তিনি বললেন,‘‘বাবা আজ আর নেই, কিন্তু তিনি সবসময়ে বলতেন যে, এমন কিছু করো, যেটা আর কেউ করেনি।’’

তবে শুধুমাত্র নিজের চ্যালেঞ্জই নয়, সমকামিতা নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে চান সমর্পণ। সেজন্যই কাজে লাগালেন মিস্টার গে ওয়ার্ল্ড ও মিস্টার গে ইন্ডিয়ার মঞ্চকে। সমর্পণের কথায়, ‘‘সমকামিতা নিয়ে জনমানসে বিশেষ করে, যাঁদের মধ্যে শিক্ষার আলো এসে পৌঁছয়নি, তাঁদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।’’ নিজেকে এক্সপ্লোর করার পাশাপাশি এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করা, এই দুই কারণেই মূলত সমর্পণ বেছে নিয়েছেন মিস্টার গে ইন্ডিয়া বা মিস্টার গে ওয়ার্ল্ডের মঞ্চ। ভারতের মতো দেশে কি সমকামিতা স্বীকৃতি পাবে আগামী দিনে? এ ব্যাপারে সমর্পণ আশাবাদী। তাঁর মতে, আগের থেকে সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে।

ছোটবেলা থেকেই মডেলিংয়ে ঝোঁক ছিল সমর্পণের। আকাঙ্ক্ষা ছিল সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ারও। বন্ধু কাম গাইড অর্চন মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে মডেলিংয়ে পা রেখেছিলেন সমর্পণ। ‘‘অর্চনই জোর করেছিল জিম করার জন্য’’, অকপট স্বীকারোক্তি সমর্পণের।
সমকামী বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, অপমানেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে সমর্পণকে। গলা শক্ত করে বললেন, ‘‘প্রথমে কেউ কেউ এমন ভাবে মিশত, যেন নিজেকে ভিনগ্রহের মানুষ বলে মনে হত।’’ তাঁর মতে, ঠিক কাজ করলে, মানুষ তাঁকে গ্রহণ করবেই। অদম্য শোনায় সমর্পণের গলা।