বেড়াতে যাওয়ার উচ্ছ্বাস ঘুরপাক খাচ্ছিল শিশু মনে। বাবার হাত ধরে স্টেশনেও পৌঁছেছিল ওরা। আচমকাই সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গেল। চোখের সামনে চলল গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আশেপাশে থাকা মানুষজন। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বাবার বুকে মুখ গুজরে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিনের সেই ৯ বছরের মেয়েটি । কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি এসে লাগল ছোট্ট মেয়েটার পায়ে। আর্তনাদ করে উঠল সে। তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। রক্তাক্ত অবস্থায় ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। ছয়-ছয়টি অস্ত্রোপচার। কিন্তু বেঁচে গেল মেয়েটি।
২৬/১১, ২০০৮। সেই রাতের ভয়ঙ্কর ঘটনা আজও স্মৃতিতে দেবিকা নটবরলাল রোটাওয়ানের। মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস স্টেশনে প্রায় ৫০ জনকে হত্যা করেছিল সমুদ্রপথে আসা পাক জঙ্গিরা। ঘটনায় আহত হন প্রায় ১০০ জনেরও বেশি। তার পর থেকেই শিরোনামে আসে এই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটি। হামলার অন্যতম মাস্টার মাইন্ড আজমল কাসাবের বিরুদ্ধে আদালতে বিচার চলছিল, তখন নয় বছরের এক কিশোরী দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সকলের। হামলার সময় সে নিজে শিবাজি টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে দেখেছিল সেদিনের সেই বীভৎসতা। সে সময় তার বয়স ছিল ৯ বছর এবং কয়েক মাসের মধ্যেই দ'শে পা দেওয়ার পালা।
কঠিন সময়ে জীবন
আদালতে কাসাবকে শনাক্তকারী সর্বকনিষ্ঠ সাক্ষী ছিলেন সেই ৯ বছরের খুদে দেবিকা। সেই সময়, ক্রাচের হাতে আদালতে পৌঁছে কাসভের হয়ে সাক্ষী দিতে দেখা যায় তাকে। গোটা দেশ তার সাহসিকতাকে স্যালুট জানিয়েছে। কেটে গিয়েছে দু'দশক। দেবিকার জীবন এখন বেশ জটিল হয়ে উঠেছে।
দেবিকা আর আগের মতো লাজুক নেই, এখন তিনি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে এবং তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এখন তার বয়স ২৪ । আজকের বিশেষ এই দিনে প্রচুর চেনা-অচেনা মানুষজন তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
দেবিকার পরিবার গত আট বছরে সরকার থেকে ১৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। কিন্তু তারপরও দেবিকার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সে চাকরি খুঁজছে। সরকার তাকে একটি বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু তিনি এখনও তার অপেক্ষা করছেন।
আইপিএস হওয়ার স্বপ্ন
আগে দেবিকা থাকতেন একচিলতে একটা ঘরে। থাকতেন কিন্তু তারপরে পুনর্বাসনের অংশ হিসাবে তাকে একটি অ্যাপার্টমেন্টে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছিল। দেবিকা চায় একজন পুলিশ অফিসার হতে । কিন্তু তিনি গত কয়েক মাস ধরে একটি চাকরি খুঁজছেন, প্রতিবারই হতাশ হয়েছেন তিনি। দেবিকা 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'কে বলেছেন যে তিনি আইপিএস অফিসার হয়ে সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটাবেন। তিনি বলেন, "এই মুহূর্তে আমি যেকোনো চাকরি খুঁজছি, তবে আমি আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব।"
দেবিকা বলেন, "আমি এমন লোকদের সম্পর্কে জানি যারা বলেন, যে 'বড় বড় কথা বললে একজন মহান মানুষ হয় না'। কিন্তু এই ধরনের লোকেরা এত বছর ধরে কঠিন পরিস্থিতিতে থাকার পরেও আমার সংগ্রামের কথা জানেন না। আমার জন্য কোনও জায়গা নেই তাদের কাছে। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এখন যে কোন একটা চাকরি আমার দরকার" ।
এদিকে আজ মুম্বই হামলার ১৫ তম বার্ষিকীতে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে ২৬/১১ মুম্বই হামলার পুলিশ কমিশনারের অফিস প্রাঙ্গণে শহীদ স্মৃতিসৌধে বীরদের পুলিশ কর্মীদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন। উপ-মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশও শহীদ স্মৃতিসৌধে বীরদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। হাজির ছিলেন মহারাষ্ট্রের গভর্নর।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'এই উপলক্ষে আমরা এই হামলায় শহীদ পুলিশ সদস্যদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছি এবং তাদের আশ্বস্ত করেছি যে আমরা সবসময় তাদের পাশে আছি'। শিন্ডে আরও বলেছেন, 'আজ মুম্বইয়ে সন্ত্রাস হামলার ১৫ বছর হয়ে গেছে এবং এই হামলার ফলে মুম্বই পুলিশ বাহিনীর যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনোই পূরণ করা যাবে না'।