Advertisment

মুজফফরনগর দাঙ্গা: ৪১টি মামলার মধ্যে ৪০টিতেই বেকসুর খালাস অভিযুক্তরা

মুজফফরনগরের একাধিক আদালত দাঙ্গায় যুক্ত ৪১টি মামলার রায় দেয় - এর মধ্যে কেবল একটি হত্যা মামলাতেই সাজা শোনানো হয়েছে। যে ৪০টি মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে, তার সবকটিই মুসলিমদের উপর হামলার ঘটনা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
মুজফফরনগর দাঙ্গা: চারটি গণধর্ষণ ও ২৬টি দাঙ্গার মামলাতেও সবাই কী করে বেকসুর খালাস

দাঙ্গার শিকাররা ত্রাণশিবিরে (ছবি- রবি কানোজিয়া)

# পাঁচজন সাক্ষী আদালতে বলেন তাঁদের আত্মীয়রা যখন খুন হন, তখন তাঁরা সেখানে ছিলেন না- এফআইআরে অবশ্য উল্টোটাই লেখা ছিল।

Advertisment

# ৬ জন সাক্ষী আদালতে বয়ানবদল করে বলেন পুলিশ তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে।

# পাঁচটি মামলায় পুলিশ হত্যার অস্ত্র আদালতে পেশ করেনি।

# বিবাদী পক্ষের তরফে পুলিশকে জেরা করা হয়নি।

#শেষ পর্যন্ত সব সাক্ষীই বিরূপ হন।

গোটা মুজফফরনগর জুড়ে ২০১৩ সালে যে সন্ত্রাস হয়েছিল, তার জেরে উত্তর প্রদেশ সরকার যে দশটি মামলা দায়ের করেছিল সেগুলির হদিশ নিতে গিয়ে এই বড় বড় ফাঁকগুলো খুঁজে পেয়েছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। মজফফরনগরে ওই হিংসার বলি হন ৬৫ জন। এ মামলার সাক্ষীদের অধিকাংশই ছিলেন নিহতদের আত্মীয়য আদালতে এঁরা বিরূপ সাক্ষী দেন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এই ১০টি মামলার সব অভিযুক্তদেরই খালাস করে দেয় আদালত।

২০১৭ সালে মুজফফরনগরের একাধিক আদালত দাঙ্গায় যুক্ত ৪১টি মামলার রায় দেয় - এর মধ্যে কেবল একটি হত্যা মামলাতেই সাজা শোনানো হয়েছে। যে ৪০টি মামলায় খালাস দেওয়া হয়েছে, তার সবকটিই মুসলিমদের উপর হামলার ঘটনা।

publive-image পোড়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে (ছবি রবি কানোজিয়া)

সব মামলাই দায়ের হয় এবং তদন্ত শুরু হয় অখিলেশ যাদব সরকারের নেতৃত্বে। বিচার চলে তাঁর এবং বিজেপি সরকারের আমলে। এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দায়রা আদালত মুজাম্মিল, মুজাসিম, ফুরকান, নাদিম, জানাগির, আফজল এবং ইকবালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ২০১৩ সালের ২৭ অগাস্ট কাওয়াল গ্রামে গৌরব এবং শচীনকে হত্যা করার। বলা হয়, এই ঘটনাই দাঙ্গার সূচনা করেছিল।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আদালতের নথি এবং অভিযোগকারী ও সাক্ষীদের বয়ান পরীক্ষা করেছে এবং বিভিন্ন আধিকারিকদের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেছে। মোট ১০টি মামলায় ৫৩জন হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি পরিবারকে পুড়িয়ে মারা থেকে তিন বন্ধুকে মাঠের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যা, একজন বাবাকে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে মারা, এক কাকাকে কোদাল দিয়ে পিটিয়ে খুনের ঘটনাও।

শুধু তাই নয়, একই রকম ধারা দেখা গিয়েছে চারটি গণধর্ষণ ও ২৬টি দাঙ্গার মামলাতেও।

উত্তরপ্রদেশ সরকার জানিয়েছে আবেদন করার কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে মুজফফরনগরের জেলা সরকারি কৌঁশুলি দুষ্যন্ত ত্যাগী জানিয়েছেন, "আমরা ২০১৩ সালের মুজফফরনগর দাঙ্গার যে খালাস তার বিরুদ্ধে কোনও আবেদন করছি না কারণ মুখ্য অভিযুক্তদের সকলকেই আদালত বিরূপ বলে ঘোষণা করেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল সাক্ষীদের বয়ানের উপর নির্ভর করেই।"

ত্যাগীর কথা অনুযায়ী, সমস্ত বিরূপ সাক্ষীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৪৪ ধারা অনুসারে মোটিস জারি করা হয়েছে।

 যে দশ মামলায় সবাই খালাস পেয়েছে তার কয়েকটি মূল দিক:

৬৯ জনের নামে অভিযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ২৪ জনকে বিচারের মুখে ফেলা হয়েছে। যে ৪৫ জনের নামে মামলা চলেছিল তাদের নাম মূল অভিযোগে ছিলই না।

প্রতিটি এফআইআরে খু্নের অস্ত্রের কথা উল্লেখ করা হলেও পুলিশ মাত্র পাঁচটি মামলায় প্রমাণ হিসেবে সেগুলি দাখিল করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আমরোড, মেহেরবান এবং আজমলের হত্যাকাণ্ডে ভিন্ন ভিন্ন মামলায় দোষীদের খালাস দিয়েছে। পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহ়ত কাস্তে একদন অভিযুক্তের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু একটি মামলায় এটি প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হয়নি, দ্বিতীয় একটি মামলায় এটিকে প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা হলেও পুলিশ বলেছে, এতে রক্তের দাগ পাওয়া যায়নি, এবং ফলত সেটিকেকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়নি, এবং তৃতীয় মামলায় পুলিশ এটি প্রমাণ হিসেবে দাখিল করলেও পুলিশের কোনও সাক্ষীকে এই অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।

publive-image "যেহেতু ধর্মস্থানের মধ্যে ওঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমরা ওঁদের কথা বিশ্বাস করেছিলাম।"

আসিমুদ্দিন এবং হালিমা হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ফুগানায়, ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। পুলিশ এ ঘটনায় দুজন নিরপেক্ষ সাক্ষীর নামোল্লেখ করেছিল, যাঁরা তল্লাশি এবং প্রমাণ বাজেয়াপ্ত করার সময়ে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুজনেই জানিয়েছে তাদের উপস্থিতিতে বাজেয়াপ্তির ঘটনা ঘটেনি এবং পুলিশ তাদের সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিল। একইভাবে ৮ সেপ্টেম্বর তিতাওইয়ে রোজুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিরপেক্ষ সাক্ষী জানান তাঁর উপস্থিতিতে কোনও বাজেয়াপ্তির ঘটনা ঘটেনি এবং সমস্ত নথি থানায় তৈরি করার পর পুলিশ তাঁকে দিয়ে সই করায়।

মীরাপুরের শরিক, তিতাউইয়ের রোজাউদ্দিন এবং মীরাপুরের নাদিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যেসব ডাক্তাররা পোস্ট মর্টেম করেছিলেন, সাক্ষী হিসেবে তাঁদের নামোল্লেখ করা হয়। কিন্তু আদালতে ডাক্তারদের বলা হয়েছিল কেবলমাত্র মেডিক্যাল পরীক্ষার নথির যাথার্থ্য বিচার করতে বলা হয়। ক্ষতের ধরন বা মৃত্যুর কারণ নিয়ে তাঁদের কোনও পাল্টা জেরা করা হয়নি।

আসিমুদ্দিন এবং হালিমা হত্যাকাণ্ডে কোনও পোস্টমর্টেম রিপোর্টই দাখিল করা হয়নি, যার ভিত্তিতে আদালত বলেছিল- অভিযোগ, এফআইআর, জেনারেল ডায়েরি এবং যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে, সে জায়গার সাইট প্ল্যান ছাড়া আর কিছুই আদালতে পেশ করা হয়নি।

mujaffarnagar riot এই মসজিদেই হামলা হয় ৬৫ বছরের ইসলামের উপর (ছবি- গজেন্দ্র যাদব)

যে ১০টি মামলায় সবাই খালাস পেয়েছে তার একটি হল ৬৫ বছরের ইসলাম খুনের ঘটনা। মুজফফরনগরের ফুগানা থানায় ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এ ঘটনা ঘটে।

ইসলামের ছেলে জারিফ যে এফআইআর দাখিল করেছিলেন, তাতে বলা হয়েছিল, "অভিযুক্ত হরপাল, সুনীল, ব্রহ্ম সিং, শ্রীপাল, চশমবীর, বিনোদ, সুমিত, কুলদীপ, অরবিন্দ- এরা ধর্মীয় স্লোগান দিতে দিতে আমাদের পরিবারের উপর অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। শ্রীপাল আমার বাবার মাথায় তীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে এবং ৬ জন তাঁর উপর তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওরা আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার ভাই বাবাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।"

কিন্তু সেই জারিফই আদালতে বলেন, "আমার বাবা খুন হয়েছেন, আমাদের আত্মীয় গুলজ়ার এ সম্পর্কে অভিযোগ দায়ের করেছেষ আমি শুধু দরখাস্তে সই করেছি। আদালতে যারা হাজির আছে তারা কেউ এ ঘটনায় যুক্ত ছিল না।" তিনজন অন্য সাক্ষীও আদালতে একই মর্মে বয়ান দেয়।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে কথা বলার সময়ে পেশায় মজুর জ়ারিফ বলেন, তিনি কবে আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন এবং বিরূপ বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন, সে কথা তিনি মনে করতে পারছেন না। আদালতের নথিতে লেখা রয়েছে, তাঁর বয়ানে তিনি অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে পারেননি।

কিন্তু তাঁর সেদিনের বাবাকে হত্যার স্মৃতি এখনও অটুট। "উনি হাসপাতালে মারা যান। উনি আমাদের গ্রামের হরপাল, সুনীল, শ্রীপাল, চশমবীর, বিনোদ, সুমিত পালস কুলদীপ এবং অরবিন্দকে চিহ্নিত করেছিলেন। এফআইআরে এই নামগুলি রয়েছে কারণ আমার বাবা সব অভিযুক্তদের চিহ্নিত করেছিলেন।"

তিনি বলেন, "আমাদের গ্রামের সমস্ত মুসলিম পরিবার পালিয়ে গিয়েছিল, শুধু আমরাই রয়ে গিয়েছিলাম। সরপঞ্চ সহ গ্রামের বয়স্ক মানুষরা আমাদের মসজিদে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আমাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছিলেন। যেহেতু ধর্মস্থানের মধ্যে ওঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমরা ওঁদের কথা বিশ্বাস করেছিলাম।"

"কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা বুঝতে পারি পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আমার বাবার থানা ইনচার্জকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। আমরা স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার কাছে সাহায্যের আবেদন জানাই, তিনি বলেন সেনাবাহিনী আসাছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। যারা আমাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল সে লোকগুলোই হামলা করে আমার বাবাকে হত্যা করে।"

কিন্তু আদালতের নথি অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর মুজফফরপুর দায়রা আদালতের বিচারক হিমাংশু ভাটনগরের সামনে জ়ারিফ অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে অস্বীকার করেন।

এরকম কেন করলেন? জ়ারিফের কথায়, "যারা ছাড়া পেয়ে গেছে ওরাই খুনে যুক্ত ছিল। কিন্তু আমরা দুর্বল, তাই আমাদের সমঝোতা করতে হয়েছে। আমাদের ক্ষমতা থাকলে আমরা হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট অবধি লড়াই করতাম। কিন্তু পরিবারকে খাওয়ানোর মত টাকাই আমাদের নেই, আদালতে বিচার চেয়ে কী হবে?"

খালাসের অন্য মামলাগুলির মতই ইসলামের বিচারপ্রক্রিয়া শুধু তাঁর ছেলের আদালতে বিরূপ হয়ে যাওয়াই নয়। আদালতের নথি বলেছে গোটা তদন্তপ্রক্রিয়াই স্ববিরোধিতায় ভরা এক ধাঁধা।

উদাহরণ- জ়ারিফ যে আটজনের নাম করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হরপাল, কুলদীপ, চশমবীর, সুনীল এবং বিনোদকে বিচারের মুখে ফেলা হয়েছিল। জ়ারিফ এও অভিযোগ করেছিলেন যে পুলিশ মৃত্যুর আগে তাঁর বাবার বয়ান রেকর্ড করতে অস্বীকার করে।

তিনি বলেন, "আমার বাবা সামান্য কয়েক ঘণ্টা বেঁচেছিলেন। উনি অত্যন্ত আহত ছিলেন, তিনি পুলিশকে বলেছিলেন তাঁর বয়ান রেকর্ড করতে, কারণ উনি সব হামলাকারীদেরই চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু তা না করে পুলিশ ওঁকে শামলি হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে থাকি কিন্তু বাবার বয়ান রেকর্ড করার জন্য কোনও পুলিশ এল না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রেকর্ড করা হল না কারণ পুলিশ অভিযুক্তদের বাঁচাতে চাইছিল।"

Read the Full Story in English

Indian Express
Advertisment