Advertisment

মুজফফরনগর দাঙ্গা: চারটি গণধর্ষণ ও ২৬টি দাঙ্গার মামলাতেও সবাই কী করে বেকসুর খালাস

দুজন নিগৃহীতা আদালতে বলেছেন, পুলিশ তাঁদের অভিযুক্তদের নাম শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল, যে নাম বললে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। অন্য দুজন আদালতে বলেন, ত্রাণ শিবিরে একজন "নাম-না-জানা আধিকারিক" তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Muzaffarnagar, Indian Express

শামলিতে দাঙ্গাপীড়িতদের পোড়া বাড়ি (ছবি- গজেন্দ্র যাদব)

একের পর এক সাক্ষী, এমনকী পুলিশ অফিসাররাও বিরূপ হয়ে যাচ্ছেন, ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করছেন তাঁদের ভয় দেখানো হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে- দীর্ঘ সময় চলে যাচ্ছে গণধর্ষণের ঘটনার ডাক্তারি পরীক্ষায়, একটি মামলায় সময় লাগছে তিন মাস, চিকিৎসক বা পুলিশের কোনও পাল্টা জেরা নেই- তালিকা ক্রমশ দীর্ঘতর হয়।

Advertisment

মুজফফরনগর দাঙ্গার ৪১টি মামলার মধ্যে ৪০টিতে সমস্ত অভিযুক্তরা খালাস হয়েছেন। এই মামলাগুলির আদালতের নথি পরীক্ষা করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্sরস দেখেছে ১০টি খুনের মামলায়, চারটি গণধর্ষণের মামলা এবং ২৬টি দাঙ্গার যে মামলাগুলিতে ১৬৮ জন ছাড়া পেয়ে গিয়েছে, সেগুলিতে বড় বড় ফাঁক রয়ে গিয়েছে।

২০১৩ সালের দাঙ্গায় অন্তত ৬৫ জন খুন হন, সবকটি ক্ষেত্রেই মামলা শুরু হয়েছিল অখিলেশ যাদব সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ে, বিচার চলেছে অখিলেশ সরকার এবং বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে।

আরও পড়ুন, লালুর সাধের গরিব রথ বন্ধ করল মোদী সরকার

চারটি গণধর্ষণ মামলায় আদালত অভিযুক্তদের খালাস করে দিয়েছে। এই মামলার মূল দিকগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক-

একটি মামলায় নিগৃহীতার ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে তিন মাস পর। ডাক্তার আদালতে বলেন, "আমরা ডাক্তারি পরীক্ষার সময়ে কোনও শারীরিক ক্ষতচিহ্ন পাইনি। দেখা গিয়েছে ওই মহিলা ১৭ সপ্তাহের গর্ভবতী।" দেরির কথা কোথাও উল্লিখিত হয়নি। ডাক্তার বা তদন্তকারী অফিসার কাউকেই কেন দেরি হল, এ নিয়ে পাল্টা জেরা করা হয়নি।

publive-image "যেহেতু ধর্মস্থানের মধ্যে ওঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমরা ওঁদের কথা বিশ্বাস করেছিলাম।"

দ্বিতীয় মামলায় নিগৃহীতা অভিযোগ দায়ের করার পুরো এক সপ্তাহ পর তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা করা হয়। এ ক্ষেত্রে খালাসের নির্দেশ দেওয়ার সময়ে চিকিৎসকের চূড়ান্ত মত কী, সে ব্যাপারে কোনও উল্লেখ নেই এবং সেখানে শুধু বলা হয়েছে তিনি ডাক্তারি পরীক্ষার নথি যে যথাযথ - আদালতে তিনি সে কথাই বলেছেন। তিনি পরীক্ষা করতে গিয়ে কী পেয়েছেন, সে নিয়ে একটি শব্দেরও উল্লেখ নেই।

তৃতীয় মামলায় কোনও ক্রমে কেবল ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে কী পাওয়া গিয়েছে, আদালত শুধু সে সম্পর্কেই নীরব নয়- ডাক্তারকে সাক্ষীতালিকাতেও রাখা হয়নি। এটি সম্পূর্ণ আইনবিরোধী কাজ।

চতুর্থ মামলায়, আদালতের নির্দেশই উল্লেখ করা হয়েছে নিগৃহীতা অভিযোগ দায়ের করার ৪০ দিন পর তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে। ডাক্তার তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন, "নিগৃহীতা পাঁচ সন্তানের মা এবং তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা করার কোনও মানে হয় না... এবং ধর্ষণের কোনও চিহ্ন নেই।" পরীক্ষায় বিলম্ব বা তাঁর বক্তব্য ধারণার ব্যাখ্যা করার জন্য ডাক্তারকে পাল্টা জেরা করা হয়নি।

গণধর্ষণের অভিযোগের দুটি মামলায় নিগৃহীতারা আদালতে বলেছেন পুলিশ তাঁদের অভিযুক্তদের নাম শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা করার জন্য পুলিশকে পাল্টা জেরা করা হয়নি।

mujaffarnagar riot দাঙ্গার শিকাররা ত্রাণশিবিরে (ছবি- রবি কানোজিয়া)

চারটি মামলায় মোট সাতজন সাক্ষী আদালতে ১৮০ ডিগ্রি উল্টো বক্তব্য রেখেছেন এবং পুলিশকে দেওয়া বিবৃতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এঁরা সকলেই নিগৃহীতাদের আত্মীয়। তাঁরা সকলেই বলেছেন জনতার হাত থেকে বাঁচতে তাঁরা পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছুই দেখেননি।

দুটি মামলায় সাক্ষীরা, যাঁরা নিগৃহীতার আত্মীয়, তাঁরা আদালতে বলেছেন পুলিশ নয়, দাঙ্গা ত্রাণ শিবিরে তাঁদের বয়ান লিপিবদ্ধ করেছিল অন্য কেউ।

দুজন নিগৃহীতা আদালতে বলেছেন, পুলিশ তাঁদের অভিযুক্তদের নাম শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল, যে নাম বললে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে। অন্য দুজন আদালতে বলেন, ত্রাণ শিবিরে একজন "নাম-না-জানা আধিকারিক" তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয়।

চারটি মামলার ক্ষেত্রেই আদালত বলে "ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৬৪ ধারার আওতায় চার নিগৃহীতা যে বিবৃতি দিয়েছেন তা যথেষ্ট প্রমাণ নয়।"

mujaffarnagar riot এই মসজিদেই হামলা হয় ৬৫ বছরের ইসলামের উপর (ছবি- গজেন্দ্র যাদব)

একটি গণধর্ষণের মামলা বিস্তারিত আলোচনার জন্য ধরে নেওয়া যাক। ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ফুগানা থানায় এই অভিযোগ দায়ের হয়। নিগৃহীতা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, "সেদিন কী হয়েছিল আমার সব মনে আছে। আমি দোতলায় ছিলাম, পরিবারের অন্যরা একতলায় ছিল। ৫০ জনেরও বেশি লোক অস্ত্র নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে এসে গুলি চালানো শুরু করে। যার একতলায় ছিল তারা সবাই আমাকে একা ফেলে লুকিয়ে পড়ে।"

আরও পড়ুন, অন্য পক্ষ: বিজেপিতে কি জায়গা ফাঁকা আছে?

"অভিযুক্তরা বাড়ির ভেতর ঢুকে আমাকে টানা হ্যাঁচড়া শুরু করে। আমি আটকানোর চেষ্টা করি। তিনজন আমাকে গণধর্ষণ করে। আমি ওদের প্রত্যেককে চিনতে পারি। আমার শাশুড়িও ওদের সবাইকে দেখেছে। উনিও তিনতে পারেবন। আদালতে ওই লোকগুলোই হাজির ছিল।"

তিনি বলেন "ক্ষতিপূরণের পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে প্রথমে তিনি দিল্লির এক আইনজীবী নিয়োগ করেছিলেন কিন্তু পরে ওই টাকা দিয়ে অন্য গ্রামে বাড়ি কেনেন, যা কাজটা তাঁর মতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। অভিযুক্তরা আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করে। আমার স্বামীকে কাজের জন্য টানা তিন মাস বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। আমাদের যেহেতু টাকা পয়সা কম, সে কারণে খেতের সময়ে আমাকে ফসল কাটার কাজে মজুরের কাজ করতে হয়। কাজের জায়গাতেও আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।"

publive-image পোড়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে (ছবি রবি কানোজিয়া)

"কয়েক মাস পর আমি আর উকিলের খরচ চালাতে পারছিলাম না এবং আমাকে পুলিশ বা কোর্ট কেউই কোনও প্রোটেকশন দিচ্ছিল না। এমনকি বিচার চলাকালীনও অভিযুক্তরা আমার ঠিক পাশে দাঁড়াত। আমরা হুমকি পেতেই থাকতাম। এর পর আমার পরিবার স্থির করে আর মামলা চালানো হবে না। ১৫ হাজার টাকারও কম রোজগার করে আটজনের পেট চালাতে হয় আমাদের, আমরা মামলা লড়ব কী করে! আমি চাই আমার পরিবার নিরাপদে বাঁচুক, হুমকি ছাড়া বাঁচুক। সেটা আমার কাছে একমাত্র ন্যায়বিচার।"

শুধু ধর্ষণ ও হত্যা মামলাই নয়, ২৬টি দাঙ্গার মামলাতেও দেখা যাচ্ছে যথাযথ পদ্ধতি রক্ষিত হয়নি।

দুটি মামলা অসাধারণ- দুটি ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ অফিসাররা মামলা দায়ের করেন। মামলা চলাকালীন ওই অফিসাররাই অভিযুক্তদের আদালতে চিনতে পারেননি।

এই ২৬টি মামলার তদন্তের নথির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক-

১০টি মামলায় একজন পুলিশ অফিসারকেও জেরা করা হয়নি। ১৩ জন সাক্ষী সাক্ষ্যে বলেছেন ওই অফিসাররাই সাদা কাগজে সই করান বা বুড়ো আঙুলের ছাপ নেন। ৫২ জন সাক্ষী বিরূপ প্রতিপন্ন হন এবং দাঙ্গার সময়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে সাক্ষ্যে বলেন।

আরও পড়ুন, রাজনীতিনামা: বাংলায় বিজেপি উত্থান

মুজফফরনগর জেলার নিউ মান্ডি থানায় দায়ের করা একটি এফআইআরে পুলিশ তিনজনের বিরুদ্ধে একটি দাঙ্গার মামলা করে। সাব ইন্সপেক্টর কালী চরণ এফআইআরে বলেন, বচ্চন সিং কলোনিতে প্রায় ৭৫ জনের একটি দল ধর্মীয় স্লোগান দিতে দিতে এসে দোকানে আগুনে ধরিয়ে দেয়... যারা হিংসায় জড়িত তাদের আমি স্পষ্ট চিনতে পেরেছি।

কিন্তু বিচার চলাকালীন সেই কালী চরণই আদালতে বলেন, তিনি "অন্ধকার থাকায় অভিযুক্তদের মুখ চিনতে পারেননি।" আদালত পুলিশের সমালোচনা করে বলে, যাদের দোকানে হামলা হয়েছিল তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।

ওই একই থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন অন্য এক পুলিশ অফিসার। তাতে ৯ জন অভিযুক্তের নাম ছিল। এফআইআরে এস আই রঘুরাজ সিং বলেন, "আমি গুলির আওয়াজ শুনতে পাই... দেখতে পাই একটি দল স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে এবং বলছে তারা কারফিউ অমান্য করবে। তাদের মধ্যে একজন পুলিশের দিকে গুলি চালাতে শুরু করে। আমরা অভিযুক্তকে গ্রেফতার করি এবং কয়েকজন এলাকা থেকে পালিয়ে যায়।"

কিন্তু আদালতে তিনি বলেন, "আমি গুলি চালানোর সাক্ষী ছিলাম না। আমরা অভিযুক্তদের ধরার চেষ্টা করি কিন্তু ঘটনাস্থলে খুব গোলমাল হচ্ছিল"। আরেক অফিসার, রঘুরাজ বাটি বলেন, "অভিযুক্তরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় এবং এলাকার লোক তাদের পরিচয় সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানাননি।"

রঘুরাজ আদালতে বলেন, তিনি "কোনও অ্যারেস্ট মেমো বানাননি... আমরা পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছিলাম, তার মধ্যে সরকারি নথিতে চারজনের সই আছে।"

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে মুজফফরনগরের জেলা সরকারি কৌঁশুলি দুষ্যন্ত ত্যাগী জানিয়েছেন, “আমরা ২০১৩ সালের মুজফফরনগর দাঙ্গার যে খালাস তার বিরুদ্ধে কোনও আবেদন করছি না কারণ মুখ্য অভিযুক্তদের সকলকেই আদালত বিরূপ বলে ঘোষণা করেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল সাক্ষীদের বয়ানের উপর নির্ভর করেই।”

Read the Story in English

Indian Express
Advertisment