জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত পত্রিকা 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'-এর হয়ে কলম ধরেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বুধবার প্রকাশিত এক প্রবন্ধে মোদী গান্ধীজীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে মত প্রকাশ করেছেন যে, শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বকে দিশা দেখিয়েছেন মহাত্মা।
এই প্রসঙ্গে মোদী লিখেছেন, "১৯৫৯ সালে ভারতে পৌঁছে রেভারেন্ড ডঃ মার্টিন লুথার কিং মন্তব্য করেন, 'অন্যান্য দেশে আমি পর্যটক হিসেবেও যেতে পারি, কিন্তু ভারতে আসি তীর্থযাত্রী হয়ে।' তিনি আরও বলেন, 'সবার উপরে বোধহয় এটাই সত্য যে ভারতে সামাজিক পরিবর্তনের যে অহিংস প্রক্রিয়ার বিকাশ ঘটেছে, তা আমার সম্প্রদায়ের মানুষ কাজে লাগিয়েছেন আলাবামার মন্টগমারিতে, এবং আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের সর্বত্র। আমরা দেখেছি এগুলি কার্যকরী এবং দীর্ঘস্থায়ী - এগুলি সত্যিই কাজ করে'!"
মোদীর বক্তব্য, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীই সেই দিশারি, যাঁর অনুপ্রেরণা ডঃ কিংকে ভারতের প্রতি আকর্ষিত করে। "বুধবার আমরা এই মহান আত্মার ১৫০ বছরের জন্মবার্ষিকী পালন করেছি। গান্ধীজী, অথবা বাপু, আজও সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাহস জুগিয়ে চলেছেন। তাঁর প্রতিরোধের আদর্শে আশার আলো দেখেছে আফ্রিকার একাধিক দেশ। ডঃ কিং বলেছিলেন, 'আমি যখন পশ্চিম আফ্রিকাতে ঘানার সফরে যাই, প্রধানমন্ত্রী এনক্রুমাহ আমায় বলেন যে তিনি গান্ধীজীর লেখা পড়েছেন, এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে গান্ধীজীর অহিংস প্রতিরোধের আদর্শ তাঁর দেশেও ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আমাদের আরও মনে আছে যে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও বাস বয়কট করা হয়েছে'।"
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়াত দেশনেতা তথা সে দেশে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রাণপুরুষ নেলসন ম্যান্ডেলা যে গান্ধী ভক্ত ছিলেন, সেকথা সর্বজনবিদিত। সেই ম্যান্ডেলার নাম করে মোদী লিখেছেন, "নেলসন ম্যান্ডেলা গান্ধীজীকে বলেছিলেন 'পবিত্র যোদ্ধা', এবং লিখেছিলেন, 'তাঁর অসহযোগ আন্দোলন, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে আমরা তখনই শাসিত হতে পারি যখন শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করি, এবং তাঁর অহিংস প্রতিরোধ আমাদের শতাব্দীতে অনুপ্রাণিত করেছে একাধিক ঔপনিবেশিক-বিরোধী এবং বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলনকে'।" এর সঙ্গে মোদী যোগ করেছেন, "মিঃ ম্যান্ডেলার চোখে গান্ধীজী ছিলেন ভারতীয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকান, দুইই। এই চিন্তাধারার নির্ঘাৎ সমাদর করতেন গান্ধীজী। তাঁর এক অভূতপূর্ব ক্ষমতা ছিল, মনুষ্য সমাজে আপাত বিরোধী মতের মধ্যে সেতু হয়ে দাঁড়াবার।"
মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে চিরাচরিত ভাবে যুক্ত কিছু প্রতীকচিহ্নের উল্লেখ করে মোদী লিখেছেন, "গান্ধীজী সাধারণ কিছু জিনিসের সঙ্গে বৃহত্তর রাজনীতিকে জড়িয়েছিলেন। আর কে ছিলেন, যিনি একটি দেশের আর্থিক স্বনির্ভরতা এবং ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে পারতেন একটি চরকা, এবং খদ্দরের কাপড়?"
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজীর ভুমিকার বর্ণনা করতে গিয়ে মোদীর বক্তব্য, "তাঁর চোখে স্বাধীনতা স্রেফ বাহ্যিক শাসনের অবসান ছিল না। তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নের মধ্যে নিবিড় যোগ খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক পৃথিবীর, যেখানে প্রতিটি নাগরিক সম্মানের সঙ্গে, সচ্ছলতার সঙ্গে বাঁচবেন। পৃথিবী যখন অধিকারের কথা বলছে, গান্ধীজী জোর দিয়েছেন কর্তব্যের ওপর। 'ইয়াং ইন্ডিয়া'য় তিনি লেখেন, 'অধিকারের আসল উৎপত্তিস্থল হলো কর্তব্য। আমরা যদি সকলেই আমাদের কর্তব্য পালন করি, তবে অধিকার খুঁজতে বেশিদূর যেতে হবে না।' এবং 'হরিজন' পত্রিকায় তিনি লেখেন, "যে কর্তব্যের পালন করে, তার কাছে অধিকার আপনিই এসে জড়ো হয়'।"
পরিশেষে মোদী লিখেছেন, "গান্ধীর মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আমাদের দিশা দেখানোর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মানবিকতায় যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদেরকে একত্রিত করা থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং আর্থিক স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করা, হরেক রকম সমস্যার সমাধান করেন গান্ধীজী।"