তাঁকে যে গামছাখানা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তা এখনও গলায় পরে আছেন পেয়ারে লাল। হোরি লাল চোখ বুজলেই এখনও দেখতে পান, ঝুঁকে পড়ে তাঁর পা ধুইয়ে দিচ্ছেন মোদী।
তারপর আঘাত করে বাস্তব।
আজ মঙ্গলবার প্রয়াগরাজে শেষ হচ্ছে কুম্ভমেলা, কিন্তু ২৪ ফেব্রুয়ারির সেই পাঁচটা মিনিট এখনও ভোলেন নি মেলার পাঁচ সাফাইকর্মী, যে পাঁচ মিনিট তাঁঁরা কাটিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। সেইসঙ্গে রয়ে গেছে আক্ষেপ, তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট সময় নিয়ে কথা না বলতে পারার - মাইনে বাড়ানোর অনুরোধ করতে না পারার, পাকা চাকরি চাইতে না পারার, কাজে সাহায্যের জন্য কিছু মেশিন চাইতে না পারার। হোরি লাল (৩৫) উত্তর প্রদেশের বান্দা জেলার ধোরাইতা গ্রাম থেকে কুম্ভমেলায় কাজ করতে আসেন। মুগ্ধভাবে ফিরে দেখেন সেই একঘন্টা, যখন তালাবন্ধ ঘরে আরও চারজনের সঙ্গে বসে প্রধানমন্ত্রীর আসার অপেক্ষায় ছিলেন। তারপর ঝটপট ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, তারপর তাঁদের পা ধুইয়ে, মুছিয়ে দেওয়া। "এত বড় একজন মানুষ" তাঁদের পা ধুইয়ে দেওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছিলেন হোরি, যিনি সেদিন "খুব ভালো করে" স্নান করে এসেছিলেন।
বাল্মীকি সম্প্রদায়ের সদস্য হোরি কুম্ভে আছেন নভেম্বর মাস থেকে, সঙ্গে স্ত্রী রাজকুমারী (৩২), এবং তিন ছেলে অমিত (১৫), আকাশ (১২), কপিল (১০)। বাচ্চারা মেলায় অঙ্গনওয়াড়ি ইস্কুলে যায়, রাজকুমারী নিজেও সাফাইকর্মীর কাজ করেন। এই নিয়ে চারবার কুম্ভমেলায় সাফাইকর্মী হিসেবে কাজ করছেন হোরি, গ্রামে মূলত রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। তাঁর মনে পড়ে না ২৪ ফেব্রুয়ারির মতো আরেকটা দিন। "উনি (মোদী) বিরাট মাপের মানুষ," বলেন হোরি। কিন্তু "সম্মান" পেয়ে কৃতজ্ঞ হোরি এও বলছেন, "আমাদের জীবনে কোনো তফাত হয় নি। আমরা আগেও সাফাইয়ের কাজ করতাম, এখনও করছি।"
একটা বিড়ি ধরিয়ে হোরি বলেন, এই কাজ তাঁর ভালো লাগে না। "কাজের জন্য ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে না। কাজ যাই হোক, পাকা হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীজি যদি চাকরি দিয়ে যেতেন, বড় ভালো হতো।" তাঁর বক্তব্য, বর্তমানে দিনে যে ৩১০ টাকা পান, তার চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও অনেক হয়। যতদিন তা না হচ্ছে, হোরি কাজের মাঝে ফাঁক খুঁজছেন ইদানিং, একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার। "স্বপ্নে সেই মুহূর্তটা দেখতে পাই, যখন সব ক্যামেরা আমাদের ছবি তুলছিল," বলেন তিনি।
পেয়ারে লাল (৪০), যিনি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত মোদীর দেওয়া ঘিয়ে রঙের গামছাটা পরে রয়েছেন, বলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরেকটু সময় পেলে খুব খুশি হতেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের পা ধুইয়ে দেওয়ার সময় প্রাথমিক "ধাক্কা" এবং "গৌরবের" কথা বলছেন তিনি। তারপর যোগ করছেন, "গোটা একটা মিনিটও পাই নি ওঁর সঙ্গে। ঠিক করে কথাই বলতে পারলাম না।"
পেশায় দিনমজুর পেয়ারে লাল নভেম্বর থেকে কুম্ভমেলায় সাফাইকর্মী হিসেবে কাজ করছেন, এই নিয়ে ছ'বার হলো। এসেছেন স্ত্রীকে নিয়ে। তাঁদের আট সন্তানের মধ্যে তিন ছেলেও দিনমজুরের কাজ করে। যা আয় হয়, তা যে যথেষ্ট নয়, সেটা জোর দিয়ে বলেন তিনি। "প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল আমাদের মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া। আমরা ঘরবাড়ি সব ছেড়ে এখানে আসি।" তবে এবার যখন তিনি ফিরবেন, সঙ্গে থাকবে গামছা। "এই একটাই তো প্রমাণ যে ওঁর সঙ্গে সত্যি দেখা হয়েছিল।"
অন্যদিকে জ্যোতি মেহতার রীতিমত উত্তেজিত। তাঁর মতে, তাঁদের দৈনিক বেতন অন্তত ৫০০ টাকা হওয়া উচিত। ২১ বছরের এই যুবতী প্রথমবার এলেন কুম্ভে, সঙ্গে স্বামী বাবলু (২৩), যিনি নিজেও পেশায় সাফাইকর্মী। "এই কাজে তো কোনও স্বাচ্ছন্দ্য নেই," নিজের নির্দিষ্ট তাঁবুতে বসে বলেন তিনি। তাঁবুতে যেটুকু জায়গা, সমস্তটাই জুড়ে রয়েছে তাঁদের জামাকাপড় এবং মাটিতে পাতা চটের চাদর।
জ্যোতির আরও রাগের কারণ, তাঁর মতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁর বক্তব্যকে বিকৃত করেছে সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু আফসোস রয়ে গেল, তাঁদের আসল দুঃখ দুর্দশার কথাই বলতে পারলেন না মোদীকে। "অত বড় মানুষ উনি, যা খুশি একটা বলে দিতে পারতাম?" চাকরি চাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর, বলছেন জ্যোতি। "উনি ইচ্ছে করলেই পারেন। শুধু সম্মান দিয়ে তো পেট চলে না।" 'ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং', অর্থাৎ মানুষের হাতে নর্দমা, ম্যানহোল, সেপটিক ট্যাঙ্ক ইত্যাদি পরিষ্কার করার কাজ, বন্ধ করার কথাও বলতে চেয়েছিলেন জ্যোতি। "অন্য লোকের মল-মূত্র পরিষ্কার করতে নর্দমায় ঢুকতে হবে, এটা তো ঠিক নয়। যে কাজ মেশিন দিয়ে হতে পারে, তা মানুষে করবে কেন?" স্বামীর দুপুরের খাওয়ার যোগাড় করতে উনুনের দিকে যেতে যেতে বলেন জ্যোতি।
আরও এক খুচরো কাজ করা দিনমজুর নরেশ কুমার (২৮) বান্দা জেলার নারায়ণপুর থেকে কুম্ভমেলায় আসেন অক্টোবর মাসে। বয়সের ভারে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হওয়ার আগে তাঁর বাবাও মেলায় সাফাইয়ের কাজ করতেন। তিন পুত্র-এক কন্যার পিতা নরেশের মতে, সরকার তাঁর মতো দরিদ্রদের উপেক্ষা করে। তাঁদের অন্যতম বড় সমস্যা হলো জাত, বলেন তিনি। বাল্মীকি সম্প্রদায়ের সদস্য নরেশের কথায়, "এই কাজই করে এসেছি, এই কাজই করে যাব।"
প্রধানমন্ত্রী তাঁদের পা ধুইয়ে দিয়েছেন, এটা বিরাট ব্যাপার, তা স্বীকার করেও তাঁর আক্ষেপ, একটু কথা বলা গেল না, মাইনে বাড়াতে বলা গেল না, অস্পৃশ্যতা প্রথা বন্ধ করার অনুরোধ করা গেল না। তাঁর আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সতীর্থরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন যখন তিনি বলেন, "দেশে পরিবর্তন আসা উচিত, কিন্তু তা হচ্ছে না। গরীব, পিছিয়ে থাকা মানুষ খুব কষ্টে আছেন।"
চৌবি (৩৪) এবং অমরীশ কুমার কুম্ভে এসেছেন তাঁদের দুই ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে। বড় ছেলে অরুণও (১৮) মেলায় সাফাইয়ের কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার দিনটা মনে করে চৌবি বলেন, সাত তাড়াতাড়ি সকালে উঠে, স্নান করে, সেক্টর ওয়ানের একটি হলে পৌঁছে যান সকাল এগারোটার মধ্যে। "তারপর অপেক্ষা করলাম আমরা। উনি সন্ধেবেলা এলেন," স্বামীর দিকে সম্মতির জন্য তাকিয়ে বলেন তিনি। অমরীশ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া গামছা পরে রয়েছেন। বান্দা জেলার মাঝিলা গ্রামে বেতের ঝুড়ি বানান চৌবি। কুম্ভে আসছেন গত ২০ বছর ধরে, এবছর সবচেয়ে পরিষ্কার দেখছেন মেলাকে।
কথার মাঝখানেই অমরীশ বলেন, চৌবি প্রধানমন্ত্রীকে কিছু না বললেও তিনি নিজে সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই বলতেন। অসন্তুষ্ট চৌবি মাটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলেন, "ওখানে থাকলে বুঝতে। আমাদের পাঁচজনের সঙ্গে পাঁচ মিনিটে ছিলেন উনি। মাসে ১৫,০০০ এর বদলে ২০,০০০ পাওয়া উচিত আমাদের। প্রধানমন্ত্রীর কিছু করা উচিত।"
কীভাবে বাছা হলো তাঁকে, সেই প্রসঙ্গে চৌবি বলেন কোনও নির্দিষ্ট বাছাই প্রক্রিয়া ছিল না, কিন্তু পুলিশ তাঁর গ্রামে গিয়ে নিশ্চিত করে আসে যে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করা নেই। হেসে বলেন, "কোনোদিন থানা চোখেই দেখি নি। পুলিশ কেস হবে কী করে?"
কিন্তু কিছু শর্ত ছিল, যা তিনি হয় তো জানেন না। কুম্ভমেলার সেক্টর তিনের তত্ত্বাবধানে রত রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের মেডিক্যাল অফিসার ডাঃ রবীন্দ্র কুমার ত্যাগী ওই পাঁচজন সাফাইকর্মী বাছার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের একজন। "কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আমাদের," বলছেন তিনি। "স্বাস্থ্য ভালো হতে হবে, পুলিশ কেস থাকলে চলবে না। অনেককেই আমরা বাদ দিয়েছিলাম দাঁতে দাগ থাকার জন্য বা মদ্যপান বা গুটখা খাওয়ার কারণে।"
Read the story in English