হাতে গোনা আর কয়েকটা দিন। তারপরেই প্রকাশিত হতে চলেছে আসামের এনআরসি তালিকা। আসাম বিজেপি শঙ্কিত। তাদের ভয়, বিদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে যারা এ তালিকায় চিহ্নিত হতে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে বড় সংখ্যক হিন্দু থাকবেন। এ হিন্দুরা মূলত বাংলা, নেপালি ও হিন্দিভাষী বলে আশঙ্কা রাজ্য বিজেপির।
ভয় এতটাই যে বিজেপি নেতারা এবার খুল্লমখুল্লা এনআরসি বিরোধী বক্তব্য রাখতে শুরু করেছেন। এমনকি বিজেপির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন, যেমন এবিভিপি ও হিন্দু জাগরণ মঞ্চ আসাম জুড়ে এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভও দেখাতে শুরু করেছে।
আরও পড়ুন, ঘনিয়ে আসছে এনআরসি প্রকাশের দিন, নামে যখন সব কিছু এসে যায়
আসামের মন্ত্রী তথা সরকারের মুখপাত্র চন্দ্রমোহন পাটওয়ারি বলেছেন, এনআরসি চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হবার পর আমরা বুঝতে পারি যে কার্বি আংলং ও ধিমাজির মত জেলাগুলির বহু মূলবাসী এবং সত্যিকারের নাগরিকদের নাম এনআরসি তালিকায় নেই। অন্যদিকে এমন কিছু জেলা, যেখানে আমরা ভেবেছিলাম তালিকাছুটের সংখ্যা বেশি হবে, সেখানে তেমনটা হয়নি।
গত বছর জুলাই মাসে খসড়া এনআরসি তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরেই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজ্য বিজেপি। দু মাস পর রাজ্য বিজেপির বড়সড় নেতারা গুয়াহাটিতে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে চূড়ান্ত খসড়া থেকে কয়েক লক্ষ খাঁটি ভারতীয়ের নাম বাদ পড়া নিয়ে সোচ্চার হন।
এ বছরের জুলাই মাসে কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টে এনআরসি খসড়ার নামের নমুনা পুনর্যাচাইয়ের আবেদন করে। সেখানে বলা হয় সীমান্তবর্তী জেলার ২০ শতাংশ ও অন্যত্র ১০ শতাংশ নামের পুনর্যাচাই করা হোক। কিন্তু শীর্ষ আদালত সে আবেদন খারিজ করে দেয়।
আরও পড়ুন, ভারতীয় নাগরিক কারা? কীভাবে তা স্থির করা হয়?
এবারের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল পুনর্যাচাইয়ের আবেদনের সপক্ষে বলেন, "সঠিক ও বিশুদ্ধ এনআরসি-র জন্য আমাদের সরকার মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে এনআরসি আপডেট প্রক্রিয়া পুনর্যাচাইয়ের আবেদন করেছে।"
এর আগে রাজ্য সরকার গত ১ অগাস্ট জেলাওয়ারি তালিকাছুটের তথ্য প্রকাশ করে দাবি করেগত বছরের খসড়া এনআরসি তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, ধুবড়ি, দক্ষিণ সালমারা এবং করিমগঞ্জের মত জেলায় যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা অনেক বেশি, সেখানে তালিকাছুটের সংখ্যা কম। অন্যদিকে তিনসুকিয়ার মত জেলা, যেখানে হিন্দু জনসংখ্যা ৮৮.৯৬ শতাংশ, সেখানে তালিকাছুটের সংখ্যা বেশি। দক্ষিণ সালমারায় ৯৫ শতাংশ, ধুবড়িতে ৭৯.৬৭ শতাংশ ও করিমগঞ্জে ৫৬.৩৬ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা।
সরকারি তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে খসড়া এনআরসি তে তালিকাছুটের হার ধুবড়িতে ৮.২৬ শতাংশ, করিমগঞ্জে ৭.৬৭ শতাংশ, দক্ষিণ সালমারায় ৭.২২ শতাংশ ও তিনসুকিয়ায় ১৩.২৫ শতাংশ।
আসামের এনআরসি কো অর্জিনেটর প্রতীক হাজেলা সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিলেন, তাঁরা ২৭ শতাংশ নাম পুনর্যাচাই করেছিলেন আগেই। এ নিয়ে পাটওয়ারি বলেন, "আমরা এতে সন্তুষ্ট নই। সরকারের দায়িত্ব একজন ভারতীয়ও যাতে তালিকা থেকে বাদ না পড়ে এবং একজন বিদেশিও যাতে তালিকায় না অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে তা সুনিশ্চিত করা।"
পাটওয়ারি আরও একটি অসন্তোষের বিষয়ে বললেন। খসড়া এনআরসি-তে যে ৪০ লক্ষের নাম বাদ পড়েছে তার মধ্যে ৩৬ লক্ষের কিছু বেশি ফের আবেদন করেছেন। পাটওয়ারি বলছেন, "৩.৮ লক্ষের কাছাকাছি আবেদন করেননি। তারা কারা, সে কথা আমরা দুটি কারণে জানতে চাই। প্রথমত, যদি তারা প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে না জেনে থাকে, তাহলে সরকারকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদি তারা প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে অবগত হয়েও আবেদন না করে থাকে তাহলে তারা বিদেশি, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট হাজেলাকে বলেছে রাজ্য সরকারের কাছে তালিকা দিতে, হাজেলা সে তালিকা এখনও দেননি। মানুষ এসব নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং আমাদের কর্তব্য জনগণের অসন্তোষের কথা তুলে ধরা।"
আরও পড়ুন, ফাঁস হওয়া এনআরসি পরিসংখ্যানের তাৎপর্য কী?
বিজেপি রাজ্য সভাপতি রঞ্জিত দাস অভিযোগ করছেন ধুবড়ি ও বরাপেটার মত মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলির বাসিন্দারা জাল নথি দিয়ে এনআরসি-তে নাম তুলেছেন। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ধুবড়ি ও বরাপেটায় মুসলিম জনসংখ্যার হার যথাক্রমে ৭৯.৬৭ শতাংশ ও ৭০.৭৪ শতাংশ।
রঞ্জিত দাসের অভিযোগ, "ধুবড়ি বরাপেটার মত জেলায় এনআরসি তালিকায় নাম ঢোকানোর জন্য বহু লোক নথি জাল করছে। বার্থ সার্টিফিকেটের মত নথি জাল করা হয়েছে। এনআরসি কর্তৃপক্ষ সে গুলো খতিয়ে দেখেনি, ফলে প্রচুর বেআইনি অনুপ্রবেশকারী এনআরসি-তে ঢুকে পড়েছে।"
তিনি বলেন, পার্টি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এনআরসি প্রকাশের পর সংশোধনী প্রক্রিয়া নিয়ে আবেদন করবে। তিনি বলেন, "এনআরসি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা আবেদন করব, যদি কোনও ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে অভিযোগ জমা পড়ে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আবেদন করার।"
রঞ্জিত দাস উদাহরণও দিয়েছেন। তিনি বলেন, "আমি একজন অধ্যাপকের কথা জানি যিনি তাঁর বাবার ১৯৬৫ সালের জমির নথি দিয়েছেন, তাঁকে লিঙ্কেজ ডকুমেন্টে সমস্যার জন্য বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন খাঁটি নাগরিক। ওঁর মত বহু মানুষের তালিকাছুট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা সরকারের কাছে আবেদন করব যে সব খাঁটি ভারতীয় নাগরিকের নাম বাদ পড়েছে তাঁদের আইনি সহায়তা দিতে। একজন ভারতীয়ও বাদ পড়া উচিত নয়।"
রাজ্য বিজেপির সম্পাদক তথা আসাম গোর্খা সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক কিশোর উপাধ্যায় স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন বেআইনি বাংলাদেশি মুসলিমরা এনআরসি-তে ঢুকে পড়বে। তিনি বলেন, "আদি বাসিন্দারা বাদ পড়বেন, বেআইনি বাংলাদেশি মুসলমানরা ঢুকে পড়বে। প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না। বেআইনি বাংলাদেশিরা আইনি হয়ে যাবে। এনআরসি আসামের মানুষের মৃত্যু ঘোষণা করবে।"
আরও পড়ুন, আসাম এনআরসি: কেন তেজপুর জেলে পচছেন আমিলা শাহ
নিজের পরিবারের উদাহরণ দিচ্ছেন উপাধ্যায়। তিনি বলেন, "বড় সংখ্যক গোর্খা জনতা বাদ পড়বেন- আমার নিজের বোনের নাম ওঠেনি খসড়া তালিকায়, পাঁচবার তাকে শুনানিতে যেতে হয়েছে। একই লিগ্যাসি ডকুমেন্ট দিয়ে আমরা চার ভাই খসড়া তালিকায় ঢুকে পড়েছি। আশা করছি বোনের নাম চূড়ান্ত এনআরসি-তে উঠবে।"
সব নজর নাগরিকত্ব বিলে
উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলিতে বিজেপি ও তাদের সহযোগীরা ২৪টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৭ টিতে জিতেছে। ২০১৬ সালে ১২৬ আসনের আসাম বিধানসভায় জয়ী জোটের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৬১ আসন, বিপিএফ পেয়েছিল ১৩টি ও অগপ পেয়েছিল ১৪টি আসন। নাগরিকত্ব বিল ঘিরে অবশ্য এই জোট ভেঙে গিয়েছে।
এনআরসি-র ক্ষেত্রে ধর্ম কোনও নির্ণায়ক না হলেও, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করার। এই বিলে বাংলাদেশ সহ তিনটি দেশ থেকে আগত ৬টি অমুসলিম ধর্মাবলম্বীদের নগরিকত্ব অনুমোদনের কথা বলা হয়েছে।
এ বছর রাজ্যসভায় বিলটি না পেশ করার ফলে তামাদি হয়ে যায়। তবে শাসক দল বারবার বলেছে এবার প্রয়োজনীয় সংখ্যা পেয়ে যাবার পর তারা এ বিল ফের পেশ করবে। রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, ক্যাব এনআরসি তালিকাছুট হিন্দুদের সাহায্য করবে।
আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে এই বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উঠলেও বাঙালি অধ্যুষিত ও বিজেপির দুর্গ বরাক উপত্যকায় এ বিলে ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছে।
বরাকের শিলচর লোকসভা আসন থেকে জিতেছেন বিজেপির রাজদীপ রায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি বলেন, "আমরা স্পষ্ট বলেছি এনআরসি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা হাজেলার সমালোচনাও করেছি। উনি সুপ্রিম কোর্টে বলেছেন ২৭ শতাংশ পুনর্যাচাই হয়েছে। কিসের ভিত্তিতে উনি এ কথা বলছেন! পুনর্যাচাইয়ে তৃতীয় একটি পক্ষ থাকা জরুরি নয়! উনি নিজে যে কাজ করেছেন তার পরীক্ষা উনি কীভাবে করতে পারেন! আমরা অসন্তুষ্ট এবং আমাদের বিশ্বাস বড় সংখ্যক আদি বাসিন্দারা বাদ পড়তে চলেছেন।"
বাঙালি হিন্দুদের একটি বড় অংশ আসামে উদ্বাস্তু হিসেবে রয়েছেন। এনআরসি থেকে তাঁদের বাদ পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে রাজদীপ রায় বলেন, এই সম্প্রদায় বিজেপিকে শ্যামাপ্রসাদের সময় থেকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। রাজদীপ বলেছেন, তিনি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস হবে এবং যেসব বাঙালি হিন্দুরা এনআরসি-তে ঠাঁই পাবেন না, তাঁদের সহায়তা করবে ওই বিল।
Read the Full Story in English