জামাত-উদ-দাওয়া এবং ফালাহ-ই-ইনসানিয়ত ফাউন্ডেশন, এই দুটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। এ পাকিস্তানের চেনা ছক। চাপের মুখে পড়লে পাকিস্তান এরকম একটা-দুটো সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তাদের নেতাদের নিরাপত্তামূলক হেফাজতে নেয় বা তাদের গৃহবন্দি করে। এসবই আন্তর্জাতিক স্তরে ওঠা শোরগোল থামানোর জন্য।
৯-১১ পরবর্তী কাল থেকে পাকিস্তান এভাবেই চালিয়ে আসছে। পাকিস্তানে হাফিজ সঈদের রক্ষাকর্তারা তাকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে, গত বছর নির্বাচনে সে একটি রাজনৈতিক দলও প্রতিষ্ঠা করেছে।
আরও পড়ুন: “পুলওয়ামায় হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের কী লাভ?”
২০১২ সাল থেকে আমেরিকা হাফিজ সঈদের মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার ধার্য করেছে, কিন্তু তাতে লশকর-এ-তৈবা/জামাত-উদ-দাওয়া প্রধানের কোনও সমস্যা হয়নি, বরং এ ঘোষণার পর থেকে তার জনসমক্ষে আসা বেড়ে গেছে।
গত বছর পাকিস্তানকে আমেরিকা এবং সংবাদমাধ্যমের হাত থেকে রক্ষা করতে সে আরও কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে মিলে দিফা-এ-পাকিস্তান কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছে। ইমরান খান সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাস পর তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য হাফিজ সঈদের সঙ্গে এক মঞ্চে একটি বৈঠকে যোগদান করেছেন। সেই বৈঠক ডাকা হয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে।
২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে লশকর-এ-তৈবা, জৈশ-এ-মহম্মদ সহ বেশ কয়েকটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এর পর জামাত-উদ-দাওয়া হয়ে ওঠে হাফিজ সঈদের মূল কর্মভূমি, সেই ২০০২ সালেই। লশকর-এ-তৈবাকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনও ঘোষণা করা হয়। ২০০৫ সালে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর তারাই প্রথম সংগঠন হিসেবে আর্তদের সাহায্য করার জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল।
২০০৮ সালে মুম্বই হামলার পর হাফিজ সঈদকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি এবং জামাত-উদ-দাওয়াকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। লশকর-এ-তৈবার শাখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় জামাত-উদ-দাওয়াকে। পাকিস্তান সরকার এবং পাঞ্জাব প্রদেশ সরকার এই সংগঠনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েক মাস পরেই তারা ফের মাথা তোলে, এবার নাম নেয় ফালাহ-ই-ইনসানিয়ত। সোয়াট এলাকা পাক তালিবান মুক্ত করার জন্য পাক সেনা যে অপারেশন চালিয়েছিল, তার ফলে ওই এলাকার গৃহহীন মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করে তারা।
হাফিজ সঈদ নিজে বেশ কয়েকবার গৃহবন্দি হয়েছে। ২০০২ সালে, ২০০৬ সালে জুলাই মাসে মুম্বই ট্রেন হামলার পর, এবং ২০০৯ সালে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তাকে জঙ্গি ঘোষণা করার পর। সম্প্রতি ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসেও তাকে গৃহবন্দি করা হয়েছিল। নভেম্বর মাসে সে ছাড়া পায়।
আরও পড়ুন, ‘সিন্ধু, চন্দ্রভাগা, বিতস্তার জলে ভারত হাত না দিলে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই’
গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের চাপে পাকিস্তান তাদের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন সংশোধন করে। এর আগে পর্যন্ত পাকিস্তান দুটি তালিকা অনুসারে চলত। একটি তালিকায় থাকত যারা সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইনে নিষিদ্ধ এবং অন্যটিতে থাকত নিরাপত্তা পরিষদের তালিকায় থাকা সংগঠনগুলি, যারা নজর তালিকার অন্তর্ভুক্ত থাকত। জামাত-উদ-দাওয়া, যারা নজর তালিকায় ছিল, তারা অর্ডিন্যান্স আসার পর নিষিদ্ধ হয়। তবে অর্ডিন্যান্স ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে তামাদি হয়ে যায়। ইমরান খান সরকার এ অর্ডিন্যান্স আর চালু করেনি।
গত বছর জামাত-উদ-দাওয়াকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন। কিন্তু হাফিজ সঈদ নতুন দল আল্লা হো আকবর প্রতিষ্ঠা করার পর তারা ফের কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। এদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। হাফিজ সঈদ সমস্ত আসনে প্রার্থী দিয়েছিল।
প্যারিসে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান ফালাহ-ই-ইনসানিয়ত ফাউন্ডেশন এবং জামাত-উদ-দাওয়া সম্পর্কিত সাম্প্রতিকতম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত জুন মাসে পাকিস্তান ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ২৬টি অ্যাকশন প্ল্যান কার্যকর করতে সম্মত হয়েছিল। তারা জানিয়েছিল জামাত-উদ-দাওয়া, ফালাহ-ই-ইনসানিয়ত ফাউন্ডেশন, জৈশ-এ-মহম্মদ, আল কায়েদা, দায়েশ (ইসলামিক স্টেট) এবং হাক্কানি নেটওয়ার্ক এবং তালিবানদের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স, যার ফলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
তবে পাকিস্তান সবসময়েই তাদের কৌশলগত অবস্থান কাজে লাগিয়ে জুয়া খেলে এসেছে, এবং সফলও হয়েছে। এই মুহূর্তে আমেরিকা পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে চায়। আফগান তালিবান যুদ্ধ শেষ করতে তারা উন্মুখ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এটাই তাদের দীর্ঘতম যুদ্ধ।
Read the Full Story in English