/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2022/10/supreme-court-1.jpeg)
সুপ্রিম কোর্ট।
রাহুল গান্ধীর সংসদ সদস্যপদ বাতিলের ঘোষণার পরই জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের (আরপিএ) বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছে। এতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর জনপ্রতিনিধিদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে অযোগ্য ঘোষণাকে বেআইনি ও স্বেচ্ছাচারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পিটিশনে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮(৩) ধারার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এটাকে সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করার দাবি উঠেছে।
দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর জনপ্রতিনিধিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অযোগ্য বলে ঘোষণার বিরুদ্ধে শনিবার সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে ২০১৯ সালের মানহানির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা এবং লোকসভা সাংসদ হিসাবে সদস্যপদ বাতিলের করার একদিন পরে এই জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
কে এই পিআইএল দায়ের করেছে?
কেরালার এক সমাজ কর্মী আভা মুরালিধরনের তরফে এই পিআইএল দায়ের করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। আভা মুরালীধরনের মতে, 8(3) ধারাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন। যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর সরাসরি আক্রমণ। যার আঁচ পড়তে পারে সরাসরি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাতেও।
সমাজকর্মী আভা মুরলীধরনের তরফে সুপ্রিম কোর্টে এই পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিকে শাস্তি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সদস্যপদ হারানো অসাংবিধানিক। প্রকৃতপক্ষে, এই ধারার অধীনে, ২ বছর বা তার বেশি শাস্তি হলে যে কোনও জনপ্রতিনিধির সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। পিটিশনে বলা হয়েছে যে ওয়ানাডের সাংসদ রাহুল গান্ধীর ‘অযোগ্য’ বলে ঘোষণার কারণে সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার তারিখ থেকে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ বাতিল করা হয়েছে।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১ এর ধারা ৮ (৩) এ কী লেখা আছে?
জনপ্রতিনিধিত্ব আইন ১৯৫১-এর ৮ (৩) ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে কোনও সাংসদ বা বিধায়ক যদি দুই বছর বা তার বেশি সাজাপ্রাপ্ত হন, তবে তার সদস্যপদ অবিলম্বে খারিজ করা হবে। পাশাপাশি এও উল্লেখ করা হয়েছে আগামী ৬ বছরের জন্য তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। আভা মুরালিধরনের পক্ষে দায়ের করা পিটিশনে বলা হয়েছে যে লিলি থমাস মামলার রায় রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার উদ্দেশ্যে অপব্যবহার করছে।
২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বনাম লিলি টমাস মামলায়, সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায় দেয় যে, সাংসদ বা বিধায়ককে, কোনও আদালত যদি দু'বছর বা তার বেশি কারাদণ্ড দেয়, সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জন প্রতিনিধির পদ খারিজ হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, সুরাটের এক আদালত বৃহস্পতিবার তাঁকে ফৌজদারি মানহানির জন্য দোষী সাব্যস্ত করার পরে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর, এটার নেপথ্যে ১০ জুলাই, ২০১৩ সালে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের এক যুগান্তকারী রায়ের জেরে। তার আগে আইন ছিল, দোষী সাব্যস্ত সাংসদ, বিধায়ক, বিধান পরিষদ সদস্যদের সমস্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আসন ধরে রাখার অনুমতি পাবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত পাবেন, যতক্ষণ না সুপ্রিম কোর্টে তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হন।
সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন মনমোহন সিংয়ের সরকার একটি অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল। কিন্তু, সেই অধ্যাদেশ ছিঁড়ে ফেলে বিক্ষোভ দেখান রাহুল। কংগ্রেসে তাঁর সমর্থকরাও এই বিক্ষোভে শামিল হয়েছিল। যার জেরে সরকার অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্সটি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
লিলি থমাস বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, ‘কোনও সাংসদ, বিধায়ক বা বিধান পরিষদ সদস্য, যিনি অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং ন্যূনতম ২ বছরের সাজা পেয়েছেন, তিনি অবিলম্বে সংসদের সদস্যপদ হারাবেন।’ শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশ জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ধারা ৮(৪)-কে ‘অসাংবিধানিক’ তকমা দিয়ে বাতিল করেছিল। আগের আইন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দোষমুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে উচ্চ আদালতে আবেদনের জন্য তিন মাসের ছাড় দিয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের দুই মাস পরে, ইউপিএ সরকার নির্দেশটি বাতিল করার জন্য একটি অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স পাস করেছিল। কারণ, পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে কংগ্রেসের মিত্র তথা আরজেডি সুপ্রিমো লালুপ্রসাদ যাদবের সাংসদপদ খারিজ হতে পারত। পাশাপাশি, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এবং রাজ্যসভার সাংসদ রশিদ মাসুদ সেই সময় একটি দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। আর, সাংসদ পদ খারিজের মুখে পড়েছিলেন। তাই, ইউপিএ সরকার সেই সময় অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশটি পাশ করেছিল বলে মনে করা হয়েছিল। বিজেপি এবং বামপন্থী-সহ তৎকালীন বিরোধীরা এই অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স নিয়ে মনমোহন সিং সরকার এবং কংগ্রেসের কঠোর সমালোচনা করেছিল। আর, দোষী সাব্যস্ত আইন প্রণেতাদের রক্ষা করার চেষ্টার অভিযোগ এনেছিল। এই অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশটি পাশ হওয়ার কয়েকদিন পরে, ২৭ সেপ্টেম্বর রাহুল দিল্লিতে দলের এক সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন। এত বছর পরে সেই যুগান্তকারী রায়ের কারণেই সাংসদ পদ হারালেন রাহুল গান্ধি।
চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি খুনের চেষ্টার দায়ে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন লাক্ষাদ্বীপের ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির সাংসদ মহম্মদ ফয়জল। ফলে লোকসভার সাংসদ পদ খারিজ হয়ে যায় তাঁর। এবার সাংসদ পদ খারিজ হল রাহুলের। তবে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে রাহুলের। সেখানে নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত স্থগিত হলে অথবা খারিজ হলে, সাংসদ পদ ফিরে পেতে পারেন তিনি।
অধ্যাদেশে কি এই বিধান ছিল?
২০১৩সালে আনা অধ্যাদেশে, বিধায়ক বা সাংসদকে শাস্তির পরে ৩ মাসের জন্য সুরক্ষার বিধান দেওয়া হয়। অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল যে দোষী সাব্যস্ত বর্তমান এমপি/বিধায়ককে ৩ মাসের জন্য তার সদস্যপদ বাতিল করা যাবে না। যদি এই তিন মাসের মধ্যে বর্তমান সাংসদ/বিধায়ক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে উচ্চাদালতে আপিল দায়ের করেন, তাহলে তাকে তার সদস্যপদ বাতিল বলে ঘোষণা করা যাবে না; আপিলের সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে তার সদস্যপদ।
সাংবাদিক বৈঠকে অধ্যাদেশের কপি ছিঁড়ে ফেলেন রাহুল গান্ধী
মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা অধ্যাদেশটি পাস করে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এরপর সাংবাদিক বৈঠকে অধ্যাদেশের কপি ছিঁড়ে ফেলেন রাহুল গান্ধী। পরে মন্ত্রিসভা এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করে। রাহুলের এই সিদ্ধান্ত আজ অবধি সমালোচিত।