রিচার্ড হ্যাডলি এ নিয়ে বলেছিলেন, বিরাট কোহলি সামান্য হলেও প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন। এবার প্রাক্তন ভারতীয় পেসার প্রবীণ কুমার ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসের বিশালতম নৈঃশব্দে আঘাত হানলেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কাছে অবসাদের সঙ্গে তাঁর লড়াইয়ের কথা বললেন, বললেন খেলায় ফেরার জন্য তাঁর পথ খোঁজার নিরন্তর কথা।
মাস দুয়েক আগের কথা। মিরাট শহরের এক শীতভোরে, বাড়ির অন্যরা যখন ঘুমোচ্ছেন, প্রবীণ কুমার মাফলার জড়িয় রিভলবার হাতে নিয়ে নিজের গাড়িতে চড়ে বসলেন। হাইওয়ে ধরে হু হু করে গাড়ি চালিয়ে দিলেন হরিদ্বারের দিকে। সুইংয়ের জাদু আছে তাঁর হাতে। বলাবলি হত ক্রিকেট আঙিনায়। ৮ বছর আগে শেষবার ভারতের হয়ে খেলেছিলেন তিনি। এত দ্রুত বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার ক্রোধ তাঁর অন্তরে শূন্যতা ভরে দিল, একাকীত্ব গ্রাস করল তাঁকে। সেকেন্ডগুলোকে মনে হত ঘণ্টা। অন্ধকার রাস্তায় দাঁড় করানো গাড়িতে বসে, পাশে রিভলবার। প্রবীণের তখন মনে হয়েছিল, "এসব কী! শেষই করে দিই একেবারে।"
তার পরেই তাঁর চোখ যায় গাড়িতে রাখা সন্তানদের ফোটোর দিকে। ফোটোতে ওরা হাসছে। "আমি বুঝলাম আমার ফুলের মত বাচ্চাগুলোর কথা ভেবেই আমি এ কাজ করতে পারব না, ওদের নরকের রাস্তায় ঠেলে দিতে পারব না। আমি ফিরে এলাম।"
এরপর, ৩৩ বছর বয়সী প্রবীণ যা করেন, তা ক্রীড়ানক্ষত্ররা ভাবতে পারেন না, বিশেষ করে ক্রিকেটাররা তো নয়ই, কারণ তাঁদের কেরিয়ার নির্ভর করে মাঠের বাইরের ইমেজের উপর। প্রবীণ নিজের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ডিপ্রেশন হয়েছে তাঁর। পিকে বলে পরিচিত ছিলেন তিনি। বিশ্বের তাবৎ সেরা ব্যাটসম্যানদের নিজের সুইংয়ে যিনি কুপোকাৎ করতেন, টিম মেটরা যাঁকে ডাকত মস্ত মওলা নামে, তিনি এখন ওষুধ খাচ্ছেন।
ভারতে বিষয়টা দুর্লভ হলেও ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের মানসিক অস্থিতির সঙ্গে গোপন সংগ্রামের কথা এখন ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে। ১৯৯০-এ অবসর নেওয়ার পর নিউজিল্যান্ডের প্রবাদপ্রতিম খেলোয়াড় রিচার্ড হ্যাডলি নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারের শীর্ষ থাকার সময়ে আত্মহত্যার কথা ভাবার বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল সুস্থ হওয়ার জন্য একটা ব্রেক নিয়েছিলেন। তাঁর কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার জানিয়েছেন, ম্যাক্সওয়েল কীভাবে হাসিখুশি থেকে নিজের মানসিক অস্থিতিকে আড়াল করেছিলেন। গত বছরের শেষের দিকে ম্যাক্সওয়েলের সিদ্ধান্তের পরে, ভারতীয় অধিনায়ক তথা মেগাস্টার বিরাট কোহলি ২০১৪ সালের ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে নিজের অস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন। সে সময়ে তাঁর রানের খরা চলছিল। সে পরিস্থিতিতে তাঁর মনে হয়েছিল পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোহলি বলেছিলেন তিনি মানসিক ভাবে দৃঢ় ছিলেন না সে সময়ে।
২০১৪ সালে কেরিয়ারের শেষ দিকে যখন তাঁকে ভারতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং তিনি আইপিএলেও কোনও টিম পেলেন না, সে সময় থেকেই ইঙ্গিত মিলছিল, জানিয়েছেন প্রবীণ কুমার।
অবসরের পর, ব্যাপারটা বাড়তে থাকে। কোনও মানসিক শান্তি ছিল না। ভাবনাগুলো বার বার আসছিল। সবই নেতিবাচক ভাবনা। এই ভাবনাস্রোতগুলো তাঁকে ক্লান্ত করে দিচ্ছিল, তিনি চাইছিলেন এগুলো থামুক এবার। কিন্তু তেমনটা ঘটছিল না। ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আলো ঝলকানি আর আইপিএলের গ্ল্যামার থেকে দূরে মিরাটের নতুন বাড়িতে তিনি যখন চলে আসেন, তখন হতাশা তাঁর মধ্যে বেড়ে উঠছিল। বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রবীণ, ঘর বন্ধ করে বসে বারবার দেখতেন নিজের বোলিংয়ের ভিডিও, দেখতেন রিকি পন্টিংকে আউট করা, দেখতেন ইংল্যান্ডে কত দূর বাঁক খেত তাঁর বল।
ক্রিকেট: এক একাকী ক্রীড়া
দলগত ক্রীড়ার মধ্যে ক্রিকেটকে ফেলা যায় একাকীর দলে। পেশাদার ক্রিকেটাররা নিয়মিতভাবে দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ট্যুরে যান, যেসব ট্যুর মাসের পর মাস ধরে চলে। ম্যাচের দিনগুলোতেও তাঁদের অপেক্ষা করতে হয়, দীর্ঘক্ষণ, হয় ড্রেসিংরুমে বসে অন্যদের ব্যাটিং বা ফিল্ডিং দেখতে হয়, নয়ত মাঠে গিয়েও অনেক ঘটনাক্রমের মধ্যে আলাদা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সময় জুড়ে। যে খেলায় খেলোয়াড়দের ক্রমাগত আত্মানুসন্ধান করতে বলা হয়, সে খেলা থেকে অবসর নেওয়ার সময় হলে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হয়। প্রথম, হঠাৎই স্পটলাইট থেকে চলে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, অবসরের পরেও নিজেদের সম্পর্কে অতি সমালোচনার অভ্যাস ঝেড়ে ফেলতে পারেন না ক্রিকেটাররা। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ব্রিটেনে সাধারণ পুরুষ নাগরিকরা যত সংখ্যায় আত্মহনন করেন, তার চেয়ে ৭৫ শতাংশ বেশি আত্মহত্যার পথ বেছে নেটি নেন টেস্ট ক্রিকেটাররা। উইজডেনের প্রাক্তন সম্পাদক ডেভিড ফ্রিথের বই সাইলেন্স অফ দ্য হার্টে ক্রিকেটার ও তাঁদের অবসাদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে প্রফেশনাল ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন ক্রিকেটারদের অবসাদের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে অবহিত করছে। ভারতে অবশ্য এখনও বিষয়টি নিষিদ্ধ হিসেবেই পরিগণিত।
একটা সময়ে প্রবীণ সারা রাত কাটাতেন ফ্যানের দিকে তাকিয়ে। প্রবীণের পরিবার- স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে কিছু একটা সন্দেহ করেছিলেন, কিন্তু কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দিতেন না তিনি। তার একটা কারণ, তিনি নিজেই বুঝতেন না কী ঘটছে তাঁর সঙ্গে। "ভারতে অবসাদ কে বোঝে! মিরাটে তো কেউ এ সব কথা কোনওদিন শোনেই নি, নিশ্চিত।"
ডাক্তারের সঙ্গে যখন কুমারের সেশন শুরু হয়, তিনি জানিয়েছিলেন, যৌথ পরিবার থেকে সরে এসে আলাদা বাড়িতে থাকা শুরু করতেই তাঁর মাথার মধ্যে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়। "কথা বলার মত কেউ ছিল না, সব সময়ে বিরক্তি লাগত। ফাস্ট বোলার হিসেবে আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হত ব্যাটসম্যানদের আউট করার জন্য। আমি কাউন্সেলরকে বলেছিলাম আমি ভাবনাগুলো সরাতে পারছি না।"
হঠাৎই খ্যাতির শীর্ষ থেকে সরে যাওয়া এর একটা অংশ। শূন্যতা তৈরি হয় ড্রেসিংরুমের বন্ধুত্বগুলো চলে যাওয়ায় , অ্যাড্রিনালিন শাসিত মহাবিশ্ব থেকে অপসারণে, হাজারো মানুষের সামনে খেলার উত্তেজনা থেকে দূরে সরে যাওয়ায়। প্রবীণ কুমার ডাক্তারকে বলেছিলেন একমাত্র ক্রিকেট মাঠে ফেরার ভাবনাই তাঁকে উজ্জীবিত করে তোলে।
অন্য ক্রিকেটারদের মতই, এটাই ছিল প্রবীণের পরিচিত দুনিয়া। একমাত্র। কেউ কেউ ধারাভাষ্য বা কোচিং বা প্রশাসনের মাধ্যমে ফিরে আসতে পারেন। তাঁরা সংখ্যায় কম, তাঁরা ভাগ্যবান। খেলোয়াড় হিসেবে তাঁদের যা ভূমিকা ছিল, নতুন ভূমিকা তার তুলনায় কিছুই না, কিন্তু এর বেশি তাঁরা আর কিছু পেতেও পারেন না। তাঁদের একমাত্র সান্ত্বনা, তাঁরা সে মহাবিশ্বেই রয়ে যেতে পেরেছেন।
এ ব্যাপারে একবার কথা বলবার সময়ে স্যার ভিভ রিচার্ডস বলেছিলেন, "আপনি যখন অবসর নেবেন, আপনার অবসরে সময়টা হবে, দীর্ঘ, খুব দীর্ঘ। এটা যেন একরকম মৃত্যুই।"
অন্য অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটারের মতই, নিজের সঙ্গে খেলার সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিলেন ভিভ- কখনও ধারাভাষ্যকার হিসেবে, কখনও প্রশাসক বা কোচ হিসেবে। নাদিম ওমর, পাকিস্তান সুপার লিগের একটি টিমের মালিক রিচার্ডসকে কোচিংয়ে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি একবার সংবাদপত্রে ভিভের ৬৭ বছর বয়সেও ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার বিষয়টি বলেছিলেন, "ভিভ খুব আবেগপ্রবণ, আমরা ব্যাপারটা বুঝতেই পারতাম না। প্লেয়ারদের সাফল্য ব্যর্থতায় উনি হাসতেন, কাঁদতেন।"
ক্রিকেটের কিছু কাজের সঙ্গে তাঁর যুক্ত থাকার আকাঙ্ক্ষার কথা স্বীকার করে নিয়ে প্রবীণ কুমার বললেন, "আমার কিছু করার নেই। আমি কিছু করতে চাই, কিন্তু আমি কিছু করতে পারছি না।"
একসময়ের সুইংয়ের রাজা যখন উত্তর প্রদেশের স্পোর্টস হস্টেলে বালক বয়সে চলে এলেন, কাপের পর কাপ চা খেতে খেতে কেবল ক্রিকেটের কথা বলতেন, সেই তখন থেকই তাঁর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে ক্রিকেট। হোস্টেলে আসার চার বছর পর ২০০৫ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলার জন্য ডাক পান তিনি। স্টাম্পের কাছ থেকে করা তাঁর ডেলিভারি শেষ মুহূর্তে বেঁকে ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে দিত। ফলে দ্রুতই নজরে পড়েন তিনি। সুইং সম্পর্কে তিনটি বা দুটি কথা যিনি জানেন, সেই মনোজ প্রভাকর প্রবীণ কুমারকে জাদুকর বলে অভিহিত করেছিলেন।
২০০৭-এ এল আন্তর্জাতিকে খেলার ডাক। কিছুদিন চলল স্বপ্নের মত। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথম ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট জেতাই হোত, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্কদের উইকেট নেওয়াই হোক, বা ২০১১ সালে নিজের কেরিয়ারের শেষ টেস্ট সিরিজে ইংল্যান্ডে সবচেয়ে সাড়া জাগানো পেসার হিসেবেই হোক। ৬৮টা একদনের আন্তর্জাতিক আর ৬টা টেস্ট মিলিয়ে মোট ১০৪টি আন্তর্জাতিক উইকেট প্রবীণ কুমারের দখলে।
২০০৯ সালে আইপিএল চলার সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার এক হোটেলে ইংরেজ ব্যাটসম্যান কেভিন পিটারসেন, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরে তাঁর টিম মেট প্রবীণ কুমারের দিকে এগিয়ে যান। সামান্য কয়েকটা কথা বলার পর, প্রবীণ কুমারের সঙ্গে থাকা সাংবাদিকদের দিকে ফিরে পিটারসেন বলেন, "ওকে বলুন, ওকে আরেকটু ফিট হতে হবে, ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার স্পিড বাড়াতে হবে বলের। তাহলে ওকে আর খেলা যাবে না। ওকে বলুন সুইং হারানোর ভয় না পেতে। ও সুইং চলে যাবে না। পিকে, তুমি দুর্ধর্ষ বোলার...।"
খুশি হলেও প্রবীণ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এ পরামর্শের জন্য তিনি প্রস্তুত নন। "যদি সুইং হারিয়ে ফেলি তাহলে আমার আর কী থাকবে!"
কেমন ছিলেন প্রবীণ কুমার। ভুবনেশ্বর কুমারের চেয়ে একটু ভাল। কিন্তু এ কথা বলে পুরো সত্যি বলা হয় না। ভুবনেশ্বর ক্রমাগত নতুন হন, তুণীরে যোগ করেন নয়া অস্ত্র, পেস বাড়িয়ে তোলেন, বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে শামির জায়গায় স্থান পান, বিদেশের টেস্টেও।
প্রবীণের মাথা গরম বলে পরিচিতি ছিল। একবার নেটে কিছু বিশৃ্ঙ্খল ফ্যানদের দিকে উইকেট নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন। ২০১১ সালে বিশ্বকাপের সময়ে ডেঙ্গির জন্য খেলতে পারেন নি তিনি। সেবার ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। ডেঙ্গি সেরেছিল, প্রবীণের ক্রিকেট কেরিয়ার আর সেরে ওঠেনি।
২০১৪ সাল। তার আগের বছর কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে খেলার পর, আইপিএল নিলামে তিনি অবিক্রিত থেকে যান। কুমারের কথায়, "আমি খুব ভাল বল করছিলাম। ইংল্যান্ডে সবাই আমার প্রশংসা করেছিল। আমি টেস্ট কেরিয়ারের স্বপ্ন দেখছিলাম। হঠাৎ, সব শেষ হয়ে গেল।"
গোটা ব্যাপারটার একটা দার্শনিক চেহারা দিয়েছিলেন বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য পেসার বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মুনাফ প্যাটেল। এক বার তিনি বলেছিলেন, "ক্রিকেট কী রে ভাই! একটা চোট, সব শেষ। তারপর কী করবে! নিজেকে সামলাতে হবে।"
রোহিত শর্মা ২০১৪ সালে চোট পাওয়া জাহির খানের জায়গায় মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে খেলার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন প্রবীণকে। কিন্তু সে বেশিদিন টেকেনি, কোচিংয়ের কাজও একসময়ে শেষ হয়ে গেল।
গত বছর প্রবীণ কুমার একটা সুযোগ পেয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশের অনূর্ধ্ব ২৩ দলের বোলিং কোচ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে সুযোগও বেশি দিন থাকল না। নিজেই বললেন, তিনি বড্ড বেশি প্রত্যাশা করছিলেন।
এই সময়েই একরাত ছটফট করার পর ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে পড়েন তিনি, সব শেষ করে দিতে। কথা হচ্ছিল মিরাট-হরিদ্বার সড়কের উপর একটা রেস্তোরাঁয় বসে। প্রবীণ এ রেস্তোরাঁ চালান। বছর সাতেক আগে এর কাজ শুরু হয়েছিল। মূলত পার্টি আর বিয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া হয় এটি।
অবসাদ পর্যায়ে দুর্বল হয়েছেন প্রবীণ। ওজন কমেছে ১৫ কিলো। কথা বলার সময়ে মাঝে মাঝেই প্রায় তাঁর দুচোখ জলে ভরে আসছিল। কিন্তু পিকের সেই পুরনো স্পিরিট! মাঝেমাঝেই ফুটে বেরোচ্ছিল প্রত্যয়।
দোতলা একটা বাড়ি রয়েছে প্রবীণ কুমারের, শহরের একটু বাইরে। মিরাটের ছেলে মিস করেন অনেক কিছুই, পুরনো বন্ধু, প্রতিবেশী, বাড়ি ভর্তি পরিবারের লোক, বাবা-মা, ভাইয়ের পরিবার। তা ছাড়া তখন লোক আসত মাঝে মাঝে আড্ডা দেওয়ার জন্য।
লিভিং রুমে বসে নিজের বোলিংয়ের ফোটো আর ট্রফির দিকে তাকিয়ে প্রবীণ বলছিলেন "বাড়িটা কীরকম খালি-খালি লাগে। নিজের পরিবারের সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলতে পারে মানুষ! জন্ম থেকে আমি লোকজনের মধ্যে বড় হয়েছি। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে লোকে হ্যালো, সালাম দুয়া বলত। এখন কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে আমাকে নিজের রেস্তোরাঁয় যেতে হয়। কোনও কথা বলার লোক নেই।"
উত্তরপ্রদেশের এ অংশটা প্রায়ই ওয়াইল্ড ওয়েস্টের সঙ্গে তুলনা করা হয়, হিংসার কারণে। সম্প্রতি বেশ কিছু খবর প্রাকশিত হয়েছে, যেখানে প্রবীণ কুমার হাতে রাইফেল নিয়ে ডাক্তারকে তাড়া করা বা প্রতিবেশীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির কথা জানা গিয়েছে। তাতে মদ্যপান সম্পর্কিত ইঙ্গিতও রয়েছে।
মদ্যপানের কথা মেনে নিচ্ছেন প্রবীণ, তবে বলছেন মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি খবর প্রকাশিত হচ্ছে, মাঠের ব্যাডবয় ইমেজ দিয়েই দেখা হচ্ছে তাঁকে।
"আমাকে বলুন না কে মদ খায় না। মানুষের এরকম ধারণা কেন হল আমি জানি না। কেউই আমার ভাল কাজগুলোর কথা বলে না। আমি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের স্পনসর করি, আমি ১০টা মেয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করেছিস আমি ক্রিকেটারদের আর্থিক সাহায্য করি। ভারতে লোক শুধু একবার হাওয়া তুলে দেয়। আমার হাওয়া ভুল বানানো বয়েছে। কিন্তু হাওয়া তো হাওয়াই, একবার বইতে শুরু করলে কেউ কিছু করতে পারে না।"
নিজের কাঠখোট্টা, সোজাসাপটা কথা বলার ধরনের জন্য মিরাটকেই দায়ী করছেন প্রবীণ। "আমি এরকম, এরকমই ছিলাম। আমি এমন জায়গা থেকে এসেছি, যেখানে লোকে সরাসরি কথা বলে। কিন্তু সোজা সাপ্টা লোককে কেই বা পছন্দ করে?"
হৃদয়ের কথা বলতে বলতে গোপন কথাও জানিয়ে দিলেন প্রবীণ। তিনি আংশিক অন্ধত্বে ভোগেন, খেলার সময়েও ভুগতেন। "আমি ডান চোখে ভাল দেখতে পাই না। জুনিয়র ক্রিকেট খেলার সময়ে বল লেগেছিল। দিল্লির এক হাসপাতালে চিকিৎসা হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, চোখ প্রতিস্থাপন করা য়েতে পারে, কিন্তু দৃষ্টি পুরো ফিরবে না আরও খারাপ হবে, তার গ্যারান্টি নেই।"
"আপনার যদি ব্যাটিংয়ের সময়ে আমার আউটগুলো দেখেন, দেখবেন আমি প্রায়ই স্লোয়ার বলে আউট হয়েছি। তার কারণ আমি বল দেখতে পেতাম না। বাউন্সারেও একই সমস্যা হত। শুধু লেংথ বল খেলতে আমার কোনও সমস্যা হয়নি।"
পরিবারের লোকজন ছাড়া এ প্রতিবন্ধকতার কথা জানেন তাঁর বন্ধু রোহিত শর্মা। আর কেউ না।
নিজেকে যে ব্যস্ত রাখতে চান সে কথা ফের বললেন তিনি। "উত্তর প্রদেশ রণজি দলের যে একজন বোলিং কোচ নেই সে কথা কেউ কি জানে না? আমার টিমের সঙ্গে থাকা উচিত, মিরাটে বসে থাকার কথা নয় আমার।"
উত্তরপ্রদেশ ক্রিকেট আমাকে সব দিয়েছে। সে কারণেই মহম্মদ কাইফ বা পীযুষ চাওলার মত অন্য বন্ধুরা যখন অন্য রাজ্যের ব্যাপারে বলেছেন, তা শোনেননি প্রবীণ। "নিজের লোক যদি মারে ছায়ায় নিয়ে গিয়ে মারবে, অন্যরা কোথায় ফেলবে তার ঠিক নেই। আমি বন্ধুদের বলেছিস আমি সারা জীবন উত্তর প্রদেশের হয়ে খেলেছি, আমি উত্তর প্রদেশের বোলিং কোচ হতে চাই। ছোটদের শেখানোর সে স্কিল আছে, প্যাশন আছে আমার।"
তিনি বিনা ফিতেই কোচিং করতে চান। প্রবীণ কুমার বললেন, "টাকা কখনওই আগে নয়, আমি ভাগ্যবান যে আমি যশ দেখেছি। আমি শুধু ক্রিকেটে ফিরতে চাই। ওই একটা জিনিসই আমি জানি, ভালোবাসি। কেউ কেউ বলেন রাজনীতিতে যেতে, কিন্তু আমি বাড়ির পলিটিক্সই সামলাতে পারি না, বাইরে কী করব?"
চিকিৎসার অংশ হিসেবেই, প্রবীণ কুমার এখন বেশি বেশি করে বাইরে যান, মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, মিরাটে, মিরাটের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর মনে হচ্ছে এবার তিনি পারছেন। "আমি কয়েক মাস আগেও ভয় পেতাম, নিজেকে নিজে ভয় পেতাম। খারাপ সময়ে যা হয়। কেউ ফোন না তুললে খুব খারাপ লাগত। শেষ করে দিত আমায়। সে কালো দিন কেটে গেছে। ভাববেন না, পিকে ফিরবেই।"