/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/02/SAVE_20190218_023400.jpg)
পুলওয়ামা কাণ্ডের পর প্রায় ৯০ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে মর্মান্তিক ওই ঘটনার ফলে বিশ্বজোড়া সমর্থন পেয়েছে ভারত, এবং পাকিস্তানের মাটিতে বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদ, তথা মৌলানা মাসুদ আজহারের মতো সন্ত্রাসবাদীদের সে দেশে অনায়াস, প্রকাশ্য বিচরণের প্রতি দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও বিশ্বের দরবারে পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করতে উঠেপড়ে লেগেছে ভারত। মূল লক্ষ্য, ইতিমধ্যেই আর্থিকভাবে বিপন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া।
কাশ্মীর উপত্যকায় এখন পর্যন্ত সম্ভবত সবচেয়ে মারাত্মক একক জঙ্গী হানায় বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রাণ হারান কমপক্ষে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান। বিস্ফোরক বোঝাই একটি টাটা স্কর্পিও চালিয়ে সিআরপিএফ কনভয়ের একটি বাসে ধাক্কা মারে এক সুইসাইড বম্বার। ঘটনার দায় স্বীকার করে জঙ্গী সংগঠন জইশ-এ-মহম্মদ, এবং জানায় যে আত্মঘাতী ২০ বছর বয়সী জঙ্গী আদিল আহমেদ দার পুলওয়ামা জেলারই বাসিন্দা। আক্রান্ত বাসটি ছিল ৭৮ টি গাড়ি-বিশিষ্ট কনভয়ের অংশ, যেটি ২,৫৪৭ জন সিআরপিএফ কর্মীকে নিয়ে যাচ্ছিল জম্মু থেকে কাশ্মীর।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/02/rahul-gandhi-wreath-laying.jpg)
দেখে নেওয়া যাক, এখন পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ভারত সরকার।
পি৫ (P5) দেশগুলিকে হামলা সম্পর্কে অবহিত করা, নিরঙ্কুশ সমর্থন জোগাড় করা
পাকিস্তানের মাটিতে লালিত জইশ-এ-মহম্মদ হামলার দায় কবুল করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ২৫ টি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক সেরে ফেলে ভারত। এদের মধ্যে ছিল পি৫ দলের সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, রাশিয়া, ব্রিটেন, ও ফ্রান্স। এই পাঁচ রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠক করেন বিদেশ সচিব বিজয় গোখলে, যিনি প্রতিটি দেশের প্রতিনিধির কাছে আবেদন জানান, পাকিস্তানকে যেন কোনোরকম সমর্থন না দেওয়া হয়।
বিদেশ মন্ত্রকের এক সূত্রের কথায়, "পাকিস্তান যে সন্ত্রাসবাদকে রাষ্ট্রনীতির একটি অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছে, তার ওপরেই জোর দেওয়া হয় ভারতের পক্ষ থেকে।" ওই সূত্র আরো জানায়, বিদেশ মন্ত্রকের তরফে পুলওয়ামা কাণ্ডে পাকিস্তানের লিপ্ত থাকার প্রমাণ দেওয়ার সবরকম চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, এবং এই দাবিও বজায় থাকবে যে জইশ-এ-মহম্মদ ও মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক এবং প্রামাণ্য পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
একদিকে ঘটনার নিন্দায় সরব হয় রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য রাষ্ট্র, অন্যদিকে পাকিস্তানকে সরাসরি উদ্দেশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলে, এই হামলার ফলে ভারত-মার্কিন সন্ত্রাসবিরোধী কার্যকলাপ আরও সক্রিয় হবে, এবং পাকিস্তানের উচিত "এই মুহূর্তে সে দেশের মদতপুষ্ট সমস্ত জঙ্গি সংগঠনকে পরিত্যাগ করা, কারণ তাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে এই অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা, হিংসা এবং আতঙ্কের বীজ বপন করা"।
বাকি রইল চিন, যার সরকার এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে নীরবতা পালন করে যাচ্ছে। মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে ভারতের নিরন্তর কূটনৈতিক অভিযানকেও সমানে বাধা দিচ্ছে চিন।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/02/bhopal-759.jpg)
'মোস্ট ফেভারড নেশন' তকমা প্রত্যাহার, পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক ২০০ শতাংশ
শুক্রবার অরুণ জেটলি অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্বে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশ জুড়ে রব ওঠে, এই বীভৎস আক্রমণের কড়া জবাব দেওয়া হোক পাকিস্তানকে। সেদিনই পাকিস্তানকে ১৯৯৬ সালে প্রদত্ত ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’-এর তকমা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। কাশ্মীরে হামলা নিয়ে শুক্রবার সকালে রাজধানীতে জরুরি বৈঠকে বসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি। সেই বৈঠকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে জেটলি বলেন, "পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেবে সরকার। কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা চালাবে বিদেশ মন্ত্রক।" কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, "যারা হামলা চালিয়েছে এবং যারা এই হামলায় মদত দিয়েছে, তাদের বিরাট মূল্য দিতে হবে।"
উল্লেখ্য, দু দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ অতি সামান্য হলেও, বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নতি হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। ২০১৭ অর্থবর্ষে ভারত-পাকিস্তান বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২.২৯ বিলিয়ন ডলার, যা ভারতের মোট বাণিজ্যের ০.৩৫ শতাংশ।
মোস্ট ফেভারড নেশন হিসেবে পাকিস্তানের নাম প্রত্যাহৃত হওয়ার এক দিন পরেই, শনিবার নতুন সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করল ভারত। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানিয়ে দিলেন, পাকিস্তান থেকে যে কোনও পণ্য আমদানি করতে হলে ২০০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। পাকিস্তান থেকে আমদানি করা দুটি প্রধান সামগ্রী হলো ফল এবং সিমেন্ট, যেগুলির ওপর বর্তমান শুল্কের হার যথাক্রমে ৩০-৫০ শতাংশ এবং ৭.৫ শতাংশ।
এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তান থেকে ভারতের আমদানির মূল্য ছিল ৩৮১ মিলিয়ন ডলার। তুলনায় গোটা ২০১৮ অর্থবর্ষে আমদানির মূল্য ছিল ৪৮৮.৫ মিলিয়ন ডলার। আমদানি করা পণ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল ফল এবং বাদাম, জিপসাম, গন্ধক (সালফার), খনিজ তেল এবং সিমেন্ট।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/02/SAVE_20190218_024445.jpg)
তুলে নেওয়া হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের নিরাপত্তা বলয়
রবিবার জারি করা এক নির্দেশনামায় জম্মু-কাশ্মীর সরকারের তরফে জানানো হয়, পাঁচ বিচ্ছিন্নতাবাদী কাশ্মীরী নেতাকে সরকারের তরফে দেওয়া নিরাপত্তা তুলে নেওয়া হচ্ছে। যে পাঁচ নেতাকে চিহ্নিত করা হয়, তাঁরা হলেন মিরওয়াইজ ওমর ফারুক, আব্দুল গনি ভাট, বিলাল লোন, হাশিম কুরেশি, শাবির শা। সরকারি নিরাপত্তা এঁরা রবিবার সন্ধে থেকে তো পাবেনই না, পাশাপাশি জারি হয়েছে সবরকম সরকারি সুবিধে তুলে নেওয়ার নির্দেশও। এঁদের নিরাপত্তার কোনো শ্রেণী বিভাজন ছিল না, রাজ্য সরকার কেন্দ্রকে জানিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু জঙ্গি সংগঠনের জারি করা প্রাণনাশের হুমকির প্রেক্ষিতে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।
নিরাপত্তা প্রত্যাহারের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অল পার্টি হুরিয়ত কনফারেন্সের এক মুখপাত্র জানান, “সরকার এবং কাশ্মীর বিরোধী মিডিয়া বারবার রাজ্যের প্রদত্ত নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক কারণে প্রশ্ন তুলেছে, এটা জেনেও যে এর ফলে বাস্তবের সমস্যার ছবি বিন্দুমাত্র পাল্টাবে না। কোনো হুরিয়ত নেতা এই নিরাপত্তা চান নি। উল্টে সরকার জোর করে নিরাপত্তা প্রদান করেছে। দেওয়ার সিদ্ধান্তও সরকারের ছিল, তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তও তাই। এতে আমাদের কিছু এসে যায় না।
প্রতিটি অশ্রুবিন্দুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে, বললেন প্রধানমন্ত্রী
সারা দেশ যখন শোক পালন করছে, তখন বদলা নেওয়া হবেই, এমন ইঙ্গিতই শোনা গেল খোদ প্রধানমন্ত্রীর গলায়। কাশ্মীর জঙ্গি হামলার ঘটনায় "মোক্ষম জবাব" দেওয়া হবে বলে শুক্রবার নাম না করে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দেন নরেন্দ্র মোদী। কাশ্মীরের হামলায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে "বিরাট মূল্য" দিতে হবে বলে সরব হন তিনি। দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নিহত জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে দেন, প্রতিশোধ কবে, কীভাবে নেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দিল্লিতেই একটি অনুষ্ঠানে মোদী আরও বলেন, "ওরা খুব ভুল করল। ভারত ভোলে না। এই অপরাধের বিরাট মূল্য দিতে হবে ওদের।" শনিবার মহারাষ্ট্রে তিনি বলেন, "এটা শোকের সময়, সংযম দেখানোর সময়। যেসব পরিবার স্বজনহারা হয়েছেন, তাঁদের জানাতে চাই, প্রতিটি অশ্রুবিন্দুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে।"
বিরোধীদের পাশে পেলো সরকার, হামলার প্রত্যাঘাত পেলো সমর্থন
শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠক ডেকে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী জানালেন, তার পরের দু’দিন কোনোরকম রাজনৈতিক আলোচনাতে তাঁরা যাবেন না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী এ দিন পুলওয়ামার সন্ত্রাসবাদী হামলা প্রসঙ্গে বলেন, "সন্ত্রাসবাদের লক্ষ্যই হল দেশের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা। আমরা এক সেকেন্ডের জন্যেও দেশে বিভাজন আসতে দেব না। আমরা বিরোধীরাও দেশের জওয়ান এবং সরকারের সঙ্গে আছি। দেশের বুকে আঘাত লেগেছে। কেন্দ্র যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সমর্থন করব।"
এ ছাড়াও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম পার্টি, ফারুক আবদুল্লার নেতৃত্বে ন্যাশনাল কনফারেন্স, এবং শিব সেনা, সকলেই যৌথভাবে হামলার নিন্দা করে কেন্দ্রের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। শনিবার একটি সর্বদলীয় বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং।
পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন জওয়ানদের
চোখের জলে ভেসে নিহত সিআরপিএফ জওয়ানদের শেষ বিদায় জানালেন তাঁদের পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব, এবং সমগ্র দেশবাসী। দেশের ১৬ টি রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন হামলায় মৃত জওয়ানরা। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জওয়ান হারিয়েছে উত্তর প্রদেশ, যেখান থেকে এসেছিলেন ১২ জন। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে মৃতদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা, এবং পরিবারের একজনের চাকরির কথা। কেন্দ্রীয় সরকার দেশের নাগরিকদের কাছেও আবেদন জানিয়েছে যেন তাঁরা 'ভারত কে বীর' শীর্ষক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রকল্পের মাধ্যমে নিহত জওয়ানদের পরিবারদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।